মৃুুন্সিগঞ্জ, ২৫ মে, ২০২২, (আমার বিক্রমপুর)
শাইনপুকুর হোল্ডিংস লিমিটেডের বিজ্ঞাপনটির কথা মনে আছে? স্বপ্ন হলো সত্যি, এবার ইটের পর ইট! কথাটি কেমন যেন একটা ইতিবাচক ভাবনা ঢুকিয়ে দিত মনের মাঝে। এখনকার পদ্মা সেতু তখনকার স্বপ্ন।
পদ্মা সেতু শুধু রড, সিমেন্ট ও পাথরের সেতু নয়, এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের আবেগ। চ্যালেঞ্জকে জয় করার অদম্য স্পৃহা এবং আগামীতে দেশের অর্থনীতিতে অপার সম্ভাবনার হাতছানি। স্বপ্নের পদ্মা সেতু এখন বাস্তবে রুপ নিয়েছে।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা আগামী ২৫ জুন, ২০২২ সকাল ১০ টা’য় উদ্বোধন করতে যাচ্ছেন বলে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এ বিষয়টি অত্যন্ত আনন্দের। মুন্সিগঞ্জ তথা বিক্রমপুরবাসী দক্ষিনের প্রবেশদ্বারের জনপথ হিসেবেও আমরাও অত্যন্ত আনন্দিত। মুন্সিগঞ্জের লোক পদ্মা সেতুর পাশাপাশি ঢাকা-মাওয়া এক্সপ্রেসওয়ের বড় সুবিধাভোগী। পাশাপাশি পদ্মা সেতুকে ঘীরে মাওয়া এলাকায় নানা সরকারি-বেসরকারি পর্যটন ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে।
ঢাকা-মাওয়া ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়েতে দুটি সার্ভিস লেন, ৫টি ফ্লাইওভার, ১৯টি আন্ডারপাস, ২টি ইন্টারচেঞ্জ, চারটি রেলওয়ে ওভার ব্রিজ, ৪টি বড় সেতু, ২৫টি ছোট সেতু এবং ৫৪টি কালভার্ট রয়েছে। কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর স্পেশাল ওয়ার্কস অর্গানাইজেশন (পশ্চিম) যারা সড়কটি নির্মাণে সহযোগিতা করেছেন।
তবে সত্যি বলতে কী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবে রুপ নিয়েছে। যার ফলে দক্ষিণের ২১টি জেলা তাদের যাতায়াতের জন্য পদ্মা সেতু একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে। পদ্মা সেতু দিয়ে দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে যাতায়াত সহজ হবে, সময়ও কমবে। চলাচল সহজ করার পাশাপাশি অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে পদ্মা সেতু।
সমীক্ষা অনুযায়ী, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ২ শতাংশ হারে মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে ২ দশমিক ৩ শতাংশ। সহজভাবে বলা যায়, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে অর্থনীতিতে সরাসরি তিন ধরনের সুবিধা রয়েছে। প্রথমত, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন হবে। এতে ওই অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্য বিস্তার লাভ করবে। বিনিয়োগ বাড়বে।
দ্বিতীয়ত, কৃষক সরাসরি উপকৃত হবেন। তাদের উৎপাদিত পচঁনশীল পণ্য সরাসরি ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য স্থানে পাঠাতে পারবেন। এতে পণ্যের ভালো দাম পাওয়া যাবে।
তৃতীয়ত, এ সেতুর ফলে সামগ্রিকভাবে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যের বিস্তার হবে। বিশেষ করে ভারতের বাণিজ্য বাড়াতে মোংলা বন্দর ব্যবহার করা যাবে।
পদ্মা সেতুর (মূল সেতু) দৈর্ঘ্য ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার। দুই প্রান্তের উড়ালপথ (ভায়াডাক্ট) ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটার। সব মিলিয়ে সেতুর দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার। পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা। চালু হওয়ার পর পদ্মা সেতুতে দৈনিক অন্তত প্রায় ১০ থেকে ১২ হাজার গাড়ি পারাপার হবে।
কারণ, ঢাকা থেকে ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে হওয়ায় ফেরি ঘাটের বিড়ম্বনা এড়াতে সিংহভাগ গাড়ির গন্তব্য হবে পদ্মা সেতু। এতে সময় ও শ্রম দুই বাঁচবে গাড়িগুলোর। পদ্মা সেতুর আরেকটি নান্দনিক সৌন্দর্য হলো রেল সংযোগ প্রকল্প। এটি বাস্তবায়িত হলে পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকা থেকে খুলনায় রেলপথের নতুন রুট তৈরি হবে। নতুন রেলপথ দিয়ে যাতায়াতে রাজধানী থেকে খুলনার দূরত্ব কমবে ২১২ কিলোমিটার। এ রেলপথ দিয়ে খুলনায় যেতে সময় লাগবে মাত্র সাড়ে তিন ঘণ্টা।
পদ্মা সেতু নির্মাণ সংযোগ প্রকল্পে চারটি সেকশনে ঢাকা থেকে যশোর পর্যন্ত নতুন ব্রডগেজ লাইন নির্মাণ হবে। কথা হলো পদ্মা সেতুতে জমি দিয়ে ক্ষতিগ্রস্তদের একজন মুন্সিগঞ্জের লৌহজং উপজেলার মেদিনীমন্ডল গ্রামের বাসিন্দা নাজমুল ইসলামের সাথে।
সেতু নির্মাণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পৈতৃক ভিটা, কৃষি জমিসহ অনেক জমিজমা হারিয়েছি। তবে আবাসন প্রকল্পে প্লট পেয়েছি। কিন্তু পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞে আমার পরিবার খুশি। আমরা মনে করছি, এ সেতুর মধ্যমে সারা দেশের যে উপকার হবে তাতেও অংশীদার হতে পারলাম। ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক কথিত দুর্নীতির অভিযোগ তুলে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যাওয়ার পর সংস্থাটিকে অনুসরণ করে আরও তিনটি দাতা সংস্থা পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন থেকে সরে যায়। বস্তুত এ সেতু নির্মাণে দেশ ও দেশের বাইরে থেকে এসেছে নানা বাধা। বিশ্বব্যাংক ঋণচুক্তি স্থগিত করলে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা ঘোষণা দেন পদ্মা সেতু অবশ্যই হবে। তবে তা নিজস্ব অর্থায়নেই। অন্যের কাছ থেকে হাত পেতে টাকা এনে পদ্মা সেতু করব না। আমাদের জনগণের টাকায়ই পদ্মা সেতু নির্মিত হবে।
বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ ২০১০ সালের এপ্রিল মাসে Pre- qualification টেন্ডার আহ্বান করে। পরিকল্পনা ছিল ২০১১ সালের প্রথম দিকে সেতুর কাজ শুরু হবে এবং ২০১৩ সালের মধ্যে মূল সেতুর কাজ শেষ হবে। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের অভিযোগে সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায়।
শেষ পর্যন্ত সব ষড়যন্ত্র পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে পদ্মা সেতুর কর্মযজ্ঞ। নিজেদের উদ্যোগ ও অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের সাহসী পদক্ষেপ বিশ্বে আমাদের সক্ষমতার বিষয়ে নতুন ধারণার জন্ম দিয়েছে। এজন্য এই সেতু আমাদের কাছে স্বপ্নের চেয়েও বেশি কিছু।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংসদে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু ঘোষণা দেয়ার পর অর্থনীতি সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত ১৯ জুলাই ২০১২ খ্রিস্টাব্দে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুঃ জাতীয় ঐক্য সৃষ্টির সুযোগ’ শিরোনামে এক সেমিনারের আয়োজন করেন। সেমিনারে মূল প্রবন্ধে তিনি অর্থের বিভিন্ন উৎসের বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছিলেন সরকার চার বছরে ১৪ টি উৎস থেকে ৮৯ হাজার ৮২৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করতে পারে। তা দিয়ে চারটি পদ্মা সেতু তৈরি করা যায়।
তিনি আরো উল্লেখ করেছেন যে, বাংলাদেশের অর্থনীতি ১৯৭২-৭৩ সালের অর্থনীতি নয়। দেশের অর্থনীতি এখন অনেক উঁচু মাত্রায় উঠেছে। আসলেও তা সঠিক। সেতু বললে আসলে যে ছবি আমাদের মনে ভাসে সেই ছবি দিয়ে কোনোভাবেই মেলানো সম্ভব নয় ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এই অবকাঠামোকে। প্রমত্তা পদ্মায় দ্বিতল এই সেতুর ওপর দিয়ে চার লেনে চলবে গাড়ি, নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন। সেতুর তলদেশ দিয়ে বাংলাদেশে অনুমোদিত যেকোনো ধরনের নৌযান চলাচল করতে পারবে অনায়াসে।
সেতুর নিচতলা দিয়ে যাচ্ছে গ্যাসের পাইপলাইন, যে লাইন দিয়ে গ্যাস পৌঁছাবে এই জনপদসহ আশপাশের অনেক জেলায়। বিশ্বব্যাংক সম্ভবত বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি এবং বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব ও সাহস সম্বন্ধে আঁচ করতে পারে নাই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা কারো কাছে মাথা নত করার ব্যক্তি না। তাঁর ধমনীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রক্ত প্রবাহিত। বিশ্বব্যাংক বুঝতে ভুল করেছে।
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না।’ তাঁর কন্যা সেই কথা প্রমাণ করেছেন। পদ্মা সেতু আমাদের গর্বের সম্পদ, অহংকারের নিদর্শন। এই সেতু আমাদের মর্যাদার প্রতীক, আত্মসম্মানের প্রতীক, কারো কাছে মাথা নত না করে মাথা উঁচু করার প্রতীক, সক্ষমতার প্রতীক, উন্নয়নের প্রতীক এবং সর্বোপরি আমরা পারি তা প্রমাণের প্রতীক। আর এ প্রতীক রচনার বীর ও সাহসী নায়ক সফল রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। সহস্র সালাম মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
২০৪১ সালে বাংলাদেশ যে উন্নত দেশ হবে, সেক্ষেত্রে এই সেতু নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সব মিলিয়ে বলা যায়, স্বপ্নের এই সেতুকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশ। সোনালি স্বপ্ন এখন কল্পনা নয়, সত্যিই দৃশ্যমান। অনেকগুলো স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। নিশ্চয়ই এ সেতু অর্থনীতির সেতুবন্ধন ও নতুন দিগন্ত উন্মোচিত করবে, সমগ্র জাতি সে প্রত্যাশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে।