মুন্সিগঞ্জ, ২২ মে, ২০২২, (আমার বিক্রমপুর)
দেশব্যাপী অপরাধ জগতে এখন ভয়ঙ্কর আতঙ্কের নাম কিশোর গ্যাং। সারাদেশে স্কুল পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের মাঝে কিশোর গ্যাং নামে কালচার ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। রাজনৈতিক ছত্রছায়া থেকে শুরু করে অপরাধ জগত নিয়ন্ত্রণকারীদের ছত্রছায়ায় কিশোর গ্যাং হয়ে উঠেছে বেপরোয়া।
দেশের নানা ধরনের অপরাধমূলক কর্মকান্ডে ব্যবহৃত হচ্ছে কিশোর গ্যাং সদস্যরা। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাদের অপরাধের ধরনও পাল্টে যাচ্ছে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার, চাঁদাবাজি, চুরি-ছিনতাই থেকে শুরু করে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, প্রেমের বিরোধ, মাদক খুনাখুনীসহ নানা অপরাধে কিশোর-তরুণরা জড়িয়ে পড়ছে। রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এর সদস্যদের অপরাধমূলক কর্মকান্ড বেপরোয়াভাবে বেড়ে যাওয়ার ঘটনাটি আশঙ্কাজনক।
হুমকির মুখে পড়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও শিক্ষার পরিবেশ। আমার জেলা মুন্সিগঞ্জে কিশোর গ্যাং এর উৎপাতও ভয়াবহ রুপ ধারন করেছে। মানুষ অস্বস্তিকর অশান্তির মধ্যে দিনাতিপাত করছে। সমাজের নিরীহ অংশ বিশেষ করে যাদের কোনো প্রভাব প্রতিপত্তি নেই বা প্রভাবশালী মহলের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক ও যোগাযোগ নেই তাদের আতঙ্কই বেশি।
তারা তাদের সহায়-সম্পদ ও উঠতি বয়সের ছেলে-মেয়েদের নিয়ে উৎকণ্ঠায় দিন কাটায়; কখন কারা জায়গা-জমি দখল করতে আসে বা চাঁদা দাবি করে অথবা স্কুল-কলেজে পড়ুয়া মেয়েটিকে কখন কোন বখাটে বিরক্ত করে বা স্কুলে যাওয়া ছেলেটিকে তাদের গ্যাংয়ের দলে ভিড়িয়ে ফেলে।
সাম্প্রতিককালে মুন্সিগঞ্জ থেকে প্রকাশিত দৈনিক আমার বিক্রমপুর সহ অন্যান্য পত্রিকা থেকে জানলাম, গত ৭ মার্চ ২০২২ তারিখে অঙ্কন দত্ত নামে মুন্সিগঞ্জ কে. কে গভঃ ইন্সটিটিউট এর এসএসসি পরীক্ষার্থী কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যদের ছুরিকাঘাতে খুন হয়েছে। কিশোর গ্যাংরা এতো প্রভাবশালী পরিবারের সদস্য যে, নিহতের বাবা নির্মল দত্ত কোন তথ্য দিতে ভয় পাচ্ছেন।
পরিবারের নিরবতা, স্কুল ম্যানেজিং কমিটি ও শিক্ষকদের নিরবতা এবং সর্বোপরি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীদের নিরবতা নিয়ে এলাকার মানুষের মধ্যে রহস্যের সৃষ্টি হয়েছে। সত্যি বলতে, অঙ্কন দত্ত হত্যার যদি সুষ্ঠু বিচার না হয় তাহলে মুন্সিগঞ্জের ভঙ্গুর শিক্ষা ব্যবস্থা আরও একবার ভেঙ্গে পড়বে। পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রতি মানুষের আস্থা হারাবে।
এর পূর্বেও গত ২৫ মার্চ, ২০২১ তারিখে মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার উত্তর ইসলামপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের মারামারির ঘটনার পর সালিস চলাকালে ছুরিকাঘাতে তিনজন নিহত হয়েছিল। এরপর সদর উপজেলার মিরকাদিমে সিপাহীপাড়া এলাকার দুই কিশোর গ্যাং সদস্যের হাতে নৃশংসভাবে খুন হয় নয়ন মিজি। সে ঘটনাটিও চলে গেছে আড়ালে।
কিশোর গ্যাং শুধু মুন্সিগঞ্জ সদর নয়, পুরো মুন্সিগঞ্জে ছড়িয়ে পড়েছে ভয়াবহরুপে। এজন্য পরিবার, সচেতন সমাজের গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থীবৃন্দ ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এগিয়ে আসা দরকার।
পুলিশ সদর দফতর ও গোয়েন্দা সংস্থা সূত্রে জানতে পারলাম, দেশের ৬৪ জেলা, উপজেলা ও মহানগর এলাকায় অন্তত ৫ শতাধিক কিশোর গ্যাং গ্রুপ সক্রিয়। কেবলমাত্র রাজধানী ঢাকাতেই সক্রিয় ৫০ কিশোর গ্যাং। সারাদেশে এই গ্যাংয়ের সদস্য সংখ্যা ৫ থেকে ৬ হাজার হবে। এর মধ্যে রাজধানীতেই হাজার খানেক। গত তিন বছরে সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের হাতে খুন হয়েছে অর্ধশতাধিক মানুষ। তাহলে এই ভয়াবহ কিশোর গ্যাং থেকে বের হওয়ার উপায় কী।
চলুন ভাবি- ১. প্রত্যেক পরিবারের অভিভাবকের উচিত প্রত্যেক ছেলেমেয়েকে উঠতি বয়সে নজরে রাখা, তারা কী করছে না করছে সব সময় খোঁজখবর রাখা এবং তাদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশে সময় দেওয়া। ২. পরিবারের সন্তানকে বিভিন্ন চারিত্রিক গুণাবলির শিক্ষা দিতে হবে, তাকে সময় দিতে হবে এবং একইসঙ্গে সন্তানের আচার-আচরণের ওপর খেয়াল রাখতে হবে যাতে পারিবারিক শিক্ষা সমুন্নত থাকে। ৩. স্কুল শিক্ষার্থীদের সকল নিরাপত্তার দায়িত্ব স্কুল কর্তৃপক্ষের নিতে হবে। ৪. স্কুল চলাকালীন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্টে পুলিশি টহলের ব্যবস্থা করতে হবে। ৫. মাদক, কিশোর গ্যাং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যামের অপব্যবহার ও সামাজিক অবক্ষয় রোধে স্কুলে সচেতনতামূলক কর্মসূচি নিতে হবে। এ ছাড়া অবস্থার উন্নয়ন করতে হলে কমিউনিটি লিডারশিপ শক্তিশালী করতে হবে, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে একযোগে কাজ করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করতে হবে। ৬. কিশোর অপরাধ কমাতে হলে নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টিভঙ্গি আমূল পরিবর্তন দরকার। ৭. অপরাধী হিসাবে না দেখে শিশু-কিশোরদের কৃতকর্মকে মানসিক স্বাস্থ্যের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখাও জরুরি। ৮. আমাদের দেশে পর্যাপ্ত কিশোর সংশোধন কেন্দ্র নেই। গাজীপুরে দুটি এবং যশোরে একটি শিশু কিশোর উন্নয়ন কেন্দ্র আছে। ৯. সরকারি ব্যবস্থাপনায় কিশোরদের মনন ও সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের মাধ্যমে মেধা ও প্রতিভা বিকাশে শিশু একাডেমি, বাংলাদেশ স্কাউটস, গণিত অলিম্পিয়াড, রোবটিকস্ প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতাসহ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বার্ষিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানাদির আয়োজন যেমন- সংগীত, চিত্রাঙ্কন, আবৃত্তি, লেখালেখি, নাটক ইত্যাদিরও প্রায়োগিক অনুশীলন দরকার। ১০. দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকেও এগিয়ে আসতে হবে। গ্যাং সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে ডাটা বেইজ তৈরি করতে পারলে এ সমস্যা নিয়ন্ত্রণ করা অনেক সহজ। যেসব স্থানে গ্যাং সদস্যরা আড্ডা দেয়, সেসব জায়গায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সরব উপস্থিতি থাকতে হবে। গ্যাংয়ের পৃষ্ঠপোষক ও নিয়ন্ত্রকদের আইনের আওতায় আনতে হবে। যে কোনো ধরনের অপরাধ বড় রূপ নেওয়ার আগে অপরাধীকে আটক করতে হবে।
আঠারো শতকের শেষে ইংল্যান্ডের ম্যানচেস্টার শহরে কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণের জন্য স্যালফোর্ড ল্যাডস ক্লাব নামে ফুটবল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেছিল গ্রোভস্ পরিবার, আজ যার বিশ্বব্যাপী পরিচয় ম্যানচেস্টার সিটি ফুটবল ক্লাব নামে। রবার্ট ব্যাডেন পাওয়েল, যিনি স্কাউট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে বৈশ্বিকভাবে পরিচিত, তার হাত ধরেই এ ক্লাব সামনে এগিয়ে গিয়েছিল।
এভাবে শিশু-কিশোরদের সৃজনশীল কাজের পরিবেশ তৈরি করে দিলে এবং উন্নয়নমূলক কাজের দিকে আগ্রহী করে তুলতে পারলে বাংলাদেশেও কিশোর গ্যাং নামক দুঃস্বপ্নের আধিপত্য কমে যাবে বলে আশা করা যায়। এক সময় বিক্রমপুর তথা আজকের মুন্সিগঞ্জ জেলার গর্বের বিষয় ছিল শিক্ষা-সংস্কৃতি ও জ্ঞানী-গুনি ব্যক্তিবর্গ।
বর্তমানে সেই শিক্ষা-সংস্কৃতি কিশোর গ্যাংদের প্রভাবে ধ্বংস হচ্ছে, বলতে পারেন শিক্ষা ব্যবস্থা আইসিইউতে অবস্থান করছে। অবশ্যই এর জন্য দায়ী অভিভাবক, শিক্ষক, স্কুল কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় প্রশাসন ও আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। আমরা অঙ্কন দত্তের মতো আর কোন স্কুল শিক্ষার্থীতে হারাতে চাই না। আশা করি, সচেতন মহলের ঘুম ভাঙ্গবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা; আহবায়ক, মুন্সিগঞ্জ এডুকেশন মুভমেন্ট এবং গবেষনায় প্রধানমন্ত্রীর ফেলোশীপপ্রাপ্ত।