পদ্মা সেতুর কাজের অগ্রগতি ৩৯ শতাংশ : পিলারের উপর বসছে প্রথম সুপারস্ট্রাকচার
রুবেল ইসলামঃ শিগগিরই বাস্তব রুপ নিতে যাচ্ছে ৬ কোটি মানুষের অধ্যুষিত দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্নগুলো। দেশের সর্ববৃহৎ মেগা প্রকল্প পদ্মা সেতুর মূল অবকাঠামোগত নির্মাণ প্রস্তুতি এখন চলছে জোরেশোরে।
ভিত্তি প্রস্তুর স্থাপনের ১৫ বছর পর যেন এই বুঝি পদ্মার বুক চিড়ে ডানা মেলে ধরতে শুরু করবে স্বপ্নের এ সেতু। কেননা এরই মধ্যে গত কয়েক দিন পূর্বে সেতুর সুপারস্ট্রাকচার বা উপর কাঠামোর সরঞ্জাম (স্প্যান) স্থাপনের জন্য ৩ হাজার ৬০০ টন ক্ষমতার বেশী “টিয়ানইহাও” নামের একটি ভাসমান ক্রেন মাওয়া প্রকল্প এলাকায় পৌঁছে। আর এ উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন ভাসমান ক্রেন দিয়েই সেতুর স্প্যান বসানোর মাধ্যমে রূপ ধারণ করবে সেতুর আকার। এর আগে ২২ অক্টোবর জার্মান থেকে এসেছে ২ হাজার কিলোজুল ক্ষমতার নতুন আরো একটি হ্যামার। পাশাপাশি ৯ আগষ্ট থেকে সেতুর মূল অবকাঠামো (সুপারস্ট্রাকচার) নির্মাণের স্প্যানবাহী একাধিক চালান একের পর এক চীন থেকে মাওয়ায় এসে পৌঁছেছে। আর এসব স্প্যানগুলো পিলারের উপর স্থাপন শুরুর মধ্য দিয়েই দৃশ্যমান হতে শুরু করবে পদ্মা সেতু।
সব মিলিয়ে আজ শনিবার পর্যন্ত পদ্মাসেতু প্রকল্পের সার্বিক বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয়েছে ৩৯ শতাংশ। সেতুর কাজ চলছে অনেকটা নিরবিচ্ছিন্নভাবেই। সেতুর সুপারস্ট্রাকচার বা উপর কাঠামোর সরঞ্জামগুলো মাওয়ায় পাশে কুমারভোগে নির্মিত বিশাল ওয়ার্কশপেই ফিটিং করে আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারীতে তা স্থাপন কাজ শুরু করা হবে। এ পর্যন্ত মোট মূল পিলারের ৩৬টি পাইলের ও ভায়াডাক্ট পিলারের ১৯টি পাইল কাজ শেষ হয়েছে। আর নদীশাসন, এ্যাপ্রোচ রোড, মাওয়া ও জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজা নির্মাণসহ অন্যান্য ক্ষেত্রেও সব প্যাকেজ মিলিয়ে সার্বিক অগ্রগতি এখন ৩৯ শতাংশের মতো বলে সেতু কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর প্রতিটি স্প্যানের দৈর্ঘ্য ১৫০ মিটার এবং এর আনুমানিক ওজন ২ হাজার ৯০০ টন।আর চীন থেকে আসা টিয়ানইহাও ভাসমান ক্রেনের ধারণ ক্ষমতা তিন হাজার ৬০০ টন। যেগুলো এই ক্রেনের মাধ্যমে সরাসরি পিলারে বসানো হবে। ভারী ক্রেনটি চলে আসার মধ্য দিয়ে সুপারস্ট্রাকচার স্থাপনের মূল কাজ আরো এক ধাপে উন্নীত হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টরা জানান। বাংলাদেশে ভাসমান ক্রেন হিসেবে কোরিয়া থেকে আমদানি করা বিআইডাব্লিউটি এর উদ্ধারকারী জাহাজ প্রত্যয় ও নির্ভীকের ধারণ ক্ষমতা এক হাজার ৪০০ টন করে। সে তুলনায় চীনা এ ক্রেনের ক্ষমতা আড়াই গুণের বেশি। মূল সেতুর ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সুপারস্ট্রাকচারে মোট ৪১টি স্প্যান থাকবে। সেতুর এসব স্প্যানগুলো চীনের কারখানায় তৈরি হয়ে ক্রমান্বয়ে আরও সুপারস্ট্রাকচার আসছে প্রকল্প এলাকায়।
সংশ্লিষ্ট সুত্রে জানা গেছে, ইংরেজি অক্ষরের অনেকটা ‘ওয়াই’ আকৃতির আদলে নির্মাণ করা হচ্ছে পদ্মা সেতুর পিলার। এখন মাওয়া অংশের ৬ ও ৭ নং পিলারে ৩টি করে এবং জাজিরা অংশে ৩৪ নং থেকে ৪০নং পর্যন্ত মোট ৩৬টি পাইল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এ অবস্থায় ৩ মিটার পরিধির একেকটি পাইল ১২০ মিটার পদ্মার তলদেশে গিয়ে থামছে। প্রতিটি পিলারে ৬টি করে পাইল বসানো হচ্ছে। এখন পিলার গড়ে তোলার জন্য পর্যায়ক্রমে চলছে পাইল ড্রাইভিং। তবে সেতুর ২৬৪টি পাইলের মধ্যে ২৪০টি স্টিল ও ২৪টি কংক্রিট দিয়ে তৈরি। পদ্মার পাড়েই তৈরি হচ্ছে এসব পাইল চীন থেকে নিয়ে আসা। স্টিল প্লেট দিয়ে কুমারভোগ পাইল ফ্রেব্রিকেশন ওয়ার্কশপে (কারখানা) পাইল তৈরি শেষে তা বার্জে তোলা হচ্ছে। এরপর পিলার পয়েন্টে পাইল এনে শুরু হয় ড্রাইভিং। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী হ্যামারের প্রতি সেকেন্ডের আঘাতে একের পর এক পাইল যেতে থাকে নদী তলদেশে। এভাবেই একে একে শেষ করা হবে পাইলিংয়ের কাজ। এ কাজ শেষ হলেই পিলারের উপর শুধু স্প্যান বসিয়ে দিলে সেতু আকার লাভ করবে।
এদিকে স্প্যানের চালান আসার পরপরই বর্তমানে মাওয়ায় পদ্মাতীরের অদূরে ট্রাস ফেব্রিকেশন ইয়ার্ডে সেতুর উপরিভাগের (স্প্যান) জয়েন্টের কাজ চলছে। চীন এবং বাংলাদেশের শ্রমিকরা যৌথভাবে সেতুর জয়েন্ট, সেকশন, গার্ডার, টপকর্ড ও বটমকর্ড অংশের কাজ নিয়ে ব্যস্ত। এগুলোর বেশির ভাগ কাজই খুবই নিখুঁত ও স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে করা হচ্ছে। আর দ্বিতীয়টি বসানো হবে ৩৮ থেকে ৩৯ নম্বর পিলারের মাঝে। ৩৭ নম্বর পিলারে ৬টি পাইল কাজ সম্পন্ন হওয়ায় এখন পিয়ারের কাজের প্রস্তুতি চলছে। এখান থেকেই আরো দেড়শ ফুট (৩৫ মিটার) উঁচু পিলার উঠবে। আর পিলারের ওপরই বসবে স্প্যান। এই পিলার গ্রুপের দৈর্ঘ্য ১২৮ মিটার। এর মধ্যে নদীর তলদেশ থেকে মাটির গভীরেই রয়েছে ১২২ মিটার। বাকি ছয় মিটার পানির মধ্যে। বর্তমান পানির লেভেল থেকে পাইল গ্রুপটির ওপরের দিকের অংশ রয়েছে ছয় ফুট পানির নিচে। এখানে যাতে পানি ঢুকতে না পারে এমনভাবেই রাখা হয়েছে। আর পাইল গ্রুপে নামার জন্য রয়েছে সিঁড়ি। পদ্মা সেতুর পাইল গ্রুপ সম্পন্ন হওয়া এটি প্রথম পিলার। এখান থেকেই পিয়ার তৈরির কাজ চলছে। অন্যদিকে ৩৮ নম্বর পিলারের কাজও চলছে জোরেশোরে। এখানে ৪টি পাইল সম্পন্ন হয়ে গেছে। বাকি দুটি পাইলের কাজ চলছে এখানে।
২২ অক্টোবর জার্মান থেকে আসা দুই হাজার কিলোজুল ক্ষমতার নতুন হ্যামার ৩৮ নম্বর পাইল স্থাপনে কাজ করছে। এছাড়া দুম দুম শব্দে কাজ করে চলেছে দুই হাজার ৪০০ কিলোজুলের জার্মানীর আগের হ্যামারটিও। নতুন হ্যামারটি সপ্তাহ খানেক আগে চালু করা হলে পাইল স্থাপন কাজের গতি আরো বেড়ে যায়। এদিকে গত ৮ আগষ্ট জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের (ভূমিতে সংযোগ সেতুর) পাইলের কাজও শুরু হয়। যার মধ্য দিয়ে সেতু নির্মাণের কর্মপ্রস্তুতি আরো এক ধাপ এগিয়ে যায়। মঙ্গলবার পর্যন্ত জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্ট পিলারের ২২ নম্বরে ১০টি, ২০ নম্বরে ৪টি ও ২৪ নম্বরে ৪টি ও ২৮ নম্বরে একটি পাইল কাজসহ মোট ১৯টি পাইল কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ৭৫ মিটার গভীরে এগুলো স্থাপন করা হচ্ছে। এগুলো কংক্রিটের পাইল। সাধারণত দেশের অন্যান্য সেতুর ভায়াডাক্টের পাইল ৪০ মিটারের বেশি নয়। কিন্তু ভূমির বিভিন্নতার কারণে এখানে এত বেশি গভীরে পাইল স্থাপন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে সেতুর নকশা অনুযায়ী দুই তীরে ভূমিতে মোট ৩৬৫টি ভায়াডাক্টের পিলার স্থাপন করতে হবে। তবে আপাতত ২৮০টি পিলার স্থাপন হবে। অতিরিক্ত ৮৫টি পিলার হবে রেললাইন স্থাপনের সঙ্গে। এই ২৮০ পিলারের ১৮৭টিই জাজিরা প্রান্তে। ৯৩টি মাওয়া প্রান্তে। একই সাথে নদী শাসনের জন্য নদীর মাঝে মাঝে চলছে ড্রেজিং।
উচ্চ ক্ষমতার চীনা ড্রেজার ঘণ্টায় চার থেকে পাঁচ হাজার ঘন মিটার মাটি অপসারণ করছে। ড্রেজিং সম্পন্ন হলেই কয়েক ধাপে ফালানো হবে বালুর বস্তা। তবে অপসারণকৃত এসব স্থানে পাঁচ লেয়ারে ৮০০ কেজির বস্তা ফেলা হবে। এদিকে গত সপ্তাহ থেকে জাজিরা প্রান্তে ৮০০ কেজির জিও ব্যাগের ডাম্পিং কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া মাওয়া প্রান্তে সেতুর আধুনিক টোল প্লাজার নির্মাণ কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। প্রকল্প এলাকার প্রবেশ মুখে গেলেই চোখে পড়বে এটি। এছাড়া জাজিরা প্রান্তের টোল প্লাজার কাজের অগ্রগতি ৮৩ শতাংশ বলে জানা গেছে। পদ্মা সেতু প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ও নির্বাহী প্রকৌশলী দেওয়ান মোঃ আব্দুল কাদের এ প্রতিবেদক কে জানান, আগামী ডিসেম্বর বা জানুয়ারী মাসের মধ্যে যে কোন সময় উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন তিন হাজার ৬০০ টনের ক্রেনটি পদ্মা সেতুর সুপারস্ট্রাকচার স্থাপনে কাজে লাগানো হতে পারে।
মাওয়ায় পাশে কুমারভোগে নির্মিত বিশাল ওয়ার্কশপেই স্প্যানগুলো ফিটিং করে তা স্থাপন কাজ শুরু করা হবে। পদ্মা সেতুর সুপারস্ট্রাকচার ফিটিংয়ের জন্য এখন আনুসাঙ্গিক কাজগুলো চলমান রয়েছে। আর সেতুর পিলারের ওপর ১৫০ মিটার দীর্ঘ এই সুপারস্ট্রাকচারে থাকছে গার্ডারসহ দ্বিতল স্টিলের সেতু। যার নিচ দিয়ে চলবে ট্রেন এবং ওপর দিয়ে অন্য যানবাহন। এক পিলার থেকে অন্য পিলারের দূরত্ব ১৫০ মিটার। সেতুর ৩৭ থেকে ৩৮ নম্বরের দুই পিলারের মাঝেই প্রথম বসিয়ে দেওয়া হবে সুপারস্ট্রাকচার। আর দ্বিতীয়টি বসানো হবে ৩৮ থেকে ৩৯ নম্বর পিলারের মাঝে। এর ফলে দৃশ্যমান হতে শুরু করবে পদ্মা সেতু। অন্যদিকে এ পর্যন্ত মূল পিলারের মোট ৩৬টি পাইলের কাজসহ জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের (ভূমিতে সংযোগ সেতু) ১৯টি পাইলের কাজও শেষ হয়েছে। এ নিয়ে সেতুর কাজ সবমিলিয়ে ৩৯ শতাংশে উন্নীত হয়েছে বলে তিনি আরো নিশ্চিত করেন।
উল্লেখ্য, পদ্মা বহুমুখী সেতু প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। ১২ হাজার ১৩৩ কোটি ৩৯ লাখ টাকায় মূল সেতু নির্মাণের কাজ পেয়েছে চায়না মেজর ব্রীজ ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেড। চার লেনবিশিষ্ট এই সেতু ৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ২২ মিটার চওড়া। ৩৭ নম্বর পিলারের পাইল গ্রুপও সম্পন্ন হয়েছে। অন্যদিকে এটি ২০১৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হবে বলে সরকারের পক্ষ থেকে আগে থেকেই জানানো হয়েছে। সেতুর ৪২টি পিলারে ১৫০ মিটারের ৪১টি স্প্যান বসানো হবে। জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের কাজ চলছে পুরোদমে। এ দুই পিলারের ওপরই বসবে প্রথম সুপারস্ট্রাকচার।