নির্মাণাধীন পদ্মা বহুমুখী সেতুর দুই পাড়ে রীতিমতো জমি কেনার ধুম পড়েছে। আবাসন প্রকল্পসহ শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার লক্ষ্যে ইতিমধ্যে অনেক উদ্যোক্তা এখানে আগেভাগে জমি কেনা শুরু করেছেন। বিক্রি হয়ে গেছে শত শত একর জমি। যত দিন যাচ্ছে এখানে জমি কেনাবেচা তত বাড়ছে। চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বাড়ছে জমির দামও। মহাপরিকল্পনা নিয়ে দেশের বৃহৎ শিল্প গ্রুপগুলোও মাঠে নামতে চান। কিন্তু চাহিদা অনুযায়ী ও সময়মতো গ্যাস-বিদ্যুৎ পাবেন কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। এ জন্য অনেকে এক-পা এগিয়ে আবার দু-পা পিছিয়ে যাচ্ছেন। সবাই চাইছেন গুরুত্বপূর্ণ এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে আগাম নিশ্চয়তা।
শিল্পোদ্যোক্তাদের অনেকেই জানিয়েছেন, দেশের বৃহৎ পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে এখানে স্বাভাবিকভাবেই অর্থনৈতিক কর্মকান্ডের এক বিশাল মহাযজ্ঞ প্রস্তুত হবে। এ জন্য প্রয়োজন হবে দীর্ঘমেয়াদি ও টেকসই পরিকল্পনা। যেখানে অন্তত আগামী ৫০ বছরকে সামনে রেখে মাস্টারপ্ল্যান তৈরি করতে হবে। শিল্প, বাণিজ্যিক ও আবাসিক এলাকার জন্য পৃথক জোন থাকতে হবে। কিন্তু এসব পরিকল্পনার বাইরে যে যার মতো জমি কিনে প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে নানা জটিলতা দেখা দেবে। সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সেতুসংলগ্ন এলাকায় পদ্মা নদীর দুই পাড়ে প্রধান সড়কগুলোর পাশে জমি কিনেছেন অনেক শিল্পমালিক। ফরিদপুরে অর্থনৈতিক জোন গড়ে তোলার প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। এ জন্য এখন মাদারীপুর, ফরিদপুরসহ আশপাশের এলাকায় প্রধান সড়কের দুই পাশে কেনার জন্য জমি পাওয়ায় দুষ্কর হয়ে পড়েছে। বেশ কিছু হাউজিং কোম্পানি প্লট আকারে জমি বিক্রিও শুরু করেছে। যোগাযোগ সুবিধা, জমি ও শ্রমিকের সহজলভ্যতাসহ নানা সুবিধা বিবেচনায় মাদারীপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জসহ আশপাশের এলাকায় জমি কিনছেন শিল্পোদ্যোক্তারা।
ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও হামীম গ্রুপের কর্ণধার একে আজাদ বলেন, ইতিমধ্যে পদ্মা সেতুর এপারে অর্থাৎ ঢাকা ও মুন্সীগঞ্জ এলাকায় জমি প্রায় সব বিক্রি হয়ে গেছে। এখানে জমির দামও অনেক বেশি। তাই শিল্পমালিকরা এখন পদ্মা সেতুর ওপারে ফরিদপুর, মাদারীপুর ও শরীয়তপুরে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার কাজ শুরু করেছেন। ইতিমধ্যে ওই এলাকার প্রধান সড়কের পাশে জমি কিনে নিয়েছেন তারা। ফরিদপুরে ইকোনমিক জোন করার পরিকল্পনাও রয়েছে। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ সংযোগ পাওয়া গেলে অনেক শিল্পমালিক পদ্মার ওপারে চলে যাবেন। বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় গ্যাস-বিদ্যুৎ খুবই জরুরি বিষয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, পদ্মা সেতুর মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে বরিশাল ও খুলনাসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ২১ জেলার মধ্যে সরাসরি সড়ক যোগাযোগ চালু হবে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ঢাকার কেরানীগঞ্জ থেকে নড়াইল হয়ে যশোর পর্যন্ত রেল যোগাযোগ স্থাপনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এছাড়া পদ্মার আশপাশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নামে নতুন বিমানবন্দর নির্মাণে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজও শুরু হচ্ছে। পদ্মা নদীর মাধ্যমে আগে থেকেই নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু রয়েছে। এছাড়াও একটি নদীবন্দর করার পরিকল্পনা রয়েছে। এসব ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পদ্মার দুই পাড়ের সঙ্গে সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথে দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর মংলা, নির্মাণাধীন পায়রা সমুদ্রবন্দর, স্থলবন্দর বেনাপোলসহ সারা দেশের সঙ্গে ওই অঞ্চলের ত্বরিত যোগাযোগ ব্যবস্থা গড়ে উঠতে যাচ্ছে।
সেতু কর্তৃপক্ষ সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালে গাড়ি চলাচলের লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতু নির্মাণ কার্যক্রম। ইতিমধ্যে মূল সেতুর কাজ ১৪ ভাগ শেষ হয়েছে। চলছে টেস্ট পাইলিংয়ের কার্যক্রম। এছাড়া পদ্মার দুই পাড়ে অ্যাপ্রোচ সড়ক, সার্ভিস এরিয়াসহ আনুষঙ্গিক নির্মাণ কাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, দ্রুত এগিয়ে চলছে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ।
বদলে গেছে দুপাশের দৃশ্যপট : সরেজমিন দেখা গেছে, পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ শুরুর সঙ্গে ঢাকার গুলিস্তান থেকে মাওয়া পর্যন্ত শিল্প-কারখানা ও আবাসিক এলাকা গড়ে উঠছে। গত তিন বছরে ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের দুপাশের দৃশ্যপট বদলে গেছে। আবাদি ও অনাবাদি উভয় জমিরই দাম বেড়ে আকাশচুম্বী। মহাসড়কের দুপাশে অসংখ্য কোম্পানির নানা চমকের রঙ- বেরঙের চটকদারি সব ব্যানার, বিলবোর্ড ও ডিজিটাল সাইনবোর্ড শোভা পাচ্ছে। কেরানীগঞ্জের আবদুল্লাহপুর, কোচিয়া মোড়া ব্রিজ, ঢাকা-মাওয়া মহাসড়কের দুপাশে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বেশ কয়েকটি আবাসন কোম্পানি সাইনবোর্ড লাগিয়েছে। পদ্মা সেতুর স্বপ্ন দেখিয়ে যারা ক্রেতাদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা : জানা গেছে, পদ্মা নদীর দুই পাড়ের জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার মহাপরিকল্পনা নিয়েছেন শিল্পোদ্যোক্তা ও স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। ঢাকার কেরানীগঞ্জ, মাদারীপুর, শরীয়তপুর, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জসহ আশপাশ এলাকায় প্রধান সড়কগুলোর দুই পাশের জমি কিনছেন তারা। এছাড়াও বরিশাল, খুলনাসহ আশপাশের জেলাগুলোতে শিল্প-কারখানা নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন স্থানীয় ব্যবসায়ীরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, পদ্মা সেতু নির্মাণের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলে তারা অবকাঠামো কাজে হাত দেবেন। এছাড়া শিল্প-কারখানার জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ সংযোগের নিশ্চয়তা পাওয়ার পরই তারা দৃশ্যমান কার্যক্রম গ্রহণ করবেন। ওদিকে পদ্মা নদীর ওপাড়ে শরীয়তপুরের জাজিরা উপজেলা এলাকায় শিল্প-কারখানা ও গার্মেন্ট পল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনা রয়েছে স্থানীয় ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদদের। এ বিষয়ে নিজের পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে শরীয়তপুর জেলা আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহ-সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি মোবারক আলী সিকদার বলেন, পদ্মার পাড়ে শিল্প-কারখানা গড়ে তুলতে তিনি ২০ বিঘা জায়গা কিনেছেন। সেতুর নির্মাণ কাজ শেষ হলে ব্যক্তিগতভাবে বড় ধরনের গার্মেন্ট পল্লী গড়ে তোলার পরিকল্পনাও রয়েছে তার। শরীয়তপুর জেলা বিএনপির সহ-সভাপতি বিশিষ্ট শিল্পপতি শহিদুল হক সিকদার লিটু বলেন, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সুবিধা পাওয়া গেলে পদ্মা পাড়ে বড় ধরনের গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি ও স্পিনিং মিল গড়ে তোলা হবে। এ খাতে ৫শ কোটি টাকা বিনিয়োগের পরিকল্পনা করেছেন তিনি। এদিকে মাদারীপুরে আন্তর্জাতিক ক্রীড়া কমপ্লেক্স নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। নির্মিত হবে হোটেল-মোটেল ও শপিংমল। এ জন্য সড়কের দুই পাড়ে অনেকে জমি কিনেছেন। খুলনা অঞ্চলের এক ব্যবসায়ী জানান, যোগাযোগ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা ও গ্যাস সংযোগ না থাকায় দক্ষিণাঞ্চলে সেভাবে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠছে না। তারা আশা করছেন, পদ্মা সেতু হয়ে গেলে এসব সমস্যার দ্রুত সমাধান হবে। সেক্ষেত্রে নতুন নতুন শিল্প-কারখানায় উৎপাদিত পণ্য দ্রুত রফতানি করা সহজ হবে। এছাড়া মংলাবন্দরের পাশাপাশি নির্মাণাধীন পায়রাবন্দরের যাত্রা শুরু হলে তা আরও সহজ ও লাভজনক হবে।