কাজী সাব্বির আহমেদ দীপুঃ প্রশাসনের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করেই মুন্সিগঞ্জের ধলেশ্বরী, মেঘনা, নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা ও ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে রাতের বেলায় হাজার হাজার বালুবাহী বাল্ক্কহেড অবাধে চলাচল করছে।
এসব নৌযানের কারণে একাধিক নৌ দুর্ঘটনায় হতাহতের ঘটনা চিহ্নিত হওয়ার পর দুর্ঘটনা এড়াতে সংশ্নিষ্ট জেলা প্রশাসন প্রায় ৪ বছর আগে রাতের বেলায় বাল্ক্কহেড চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। সেই নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করেই চলছে বালুবাহী বাল্ক্কহেডগুলো।
অভিযোগ উঠেছে, সংশ্নিষ্ট জেলার নৌ পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব বাল্ক্কহেড চলাচল করছে। এর ফলে গত দুই বছরে ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীতে একাধিক নৌ দুর্ঘটনায় পুলিশ কনস্টেবল ইব্রাহিম হোসেন, লঞ্চযাত্রী খোরশেদ আলমসহ ১৬ ট্রলারযাত্রী নিহত হন। আহত হন অর্ধশতাধিক। অল্পের জন্য বেঁচে যান ৫ শতাধিক লঞ্চযাত্রী।
বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, দীর্ঘদিন ধরে কোনো ধরনের কারিগরি নকশা ছাড়াই মিস্ত্রি ও ওয়েল্ডারের পরিকল্পনায় এসব অবৈধ নৌযান নির্মাণ করা হচ্ছে। যারা এ নৌযান তৈরির সঙ্গে জড়িত তাদের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই। ডকইয়ার্ডগুলোরও কোনো বৈধ অনুমতির কাগজপত্র নেই। এমনকি এসব নৌযানের কোনো হুইল থাকে না।
জানা গেছে, ২০১৭ সালের ৩০ মার্চ সন্ধ্যায় শতাধিক যাত্রী নিয়ে মেঘনা নদীতে ট্রলারডুবির ঘটনায় ১৬ যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৬ নভেম্বর ধলেশ্বরী ও মেঘনা নদীর মোহনায় যাত্রীবাহী লঞ্চ ও কয়লা বহনকারী বাল্ক্কহেডের সংঘর্ষে ৯ শ্রমিক আহত হওয়ার ঘটনায় দুর্ঘটনাকবলিত বাল্ক্কহেডটির অর্ধেক অংশ নিমজ্জিত হয়ে যায়। এ ঘটনার কিছুদিন পরই রাতের বেলা বালুবাহী বাল্ক্কহেড চলাচলে কাঠপট্টি লঞ্চঘাটের অদূরে ধলেশ্বরী নদীতে বরগুনাগামী এমভি মানিক-৯ লঞ্চের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে লঞ্চটি ক্ষতিগ্রস্ত হলেও অল্পের জন্য প্রাণে রক্ষা প্রায় ৪শ’ যাত্রী। একই বছরের ১৪ ডিসেম্বর মুন্সিগঞ্জ-নারায়ণগঞ্জ নৌ রুটের ধলেশ্বরী নদীতে লঞ্চ ও বালুবাহী বাল্ক্কহেডের সংঘর্ষে অল্পের জন্য রক্ষা পান শতাধিক লঞ্চযাত্রী। এ সময় লঞ্চের ৫ যাত্রী আহত ও খোরশেদ আলম নামের এক যাত্রী নিখোঁজ হওয়ার ৩ দিন পর লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরি দল।
২০১৮ সালের ৪ জানুয়ারি সদর উপজেলার চরআবদুল্লাহপুর গ্রাম-সংলগ্ন মেঘনা নদীতে বালুবাহী বাল্ক্কহেডের ধাক্কায় নৌ পুলিশের ট্রলারডুবির ঘটনা ঘটে। এ সময় ইব্রাহিম নামের এক পুলিশ কনস্টেবল নিখোঁজ হলে ৪ দিন পর লাশ উদ্ধার করা হয়। ৩০ এপ্রিল মেঘনা নদীতে ঢেউয়ের কবলে ইটবোঝাই ট্রলারডুবিতে রফিজউদ্দিন মিয়া নামের এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। এ সময় ট্রলারে থাকা ১৩ শ্রমিক সাঁতরিয়ে তীরে উঠতে সক্ষম হন। ১৮ আগস্ট মেঘনা নদীর মোহনায় গ্রিনলাইন-২ লঞ্চের ঢেউয়ের কবলে ইটবাহী একটি ট্রলার ডুবে গেলে ১০ শ্রমিককে উদ্ধার করে কোস্টগার্ড।
সর্বশেষ চলতি বছরের ১৫ জানুয়ারি তেলবাহী ট্যাঙ্কারের ধাক্কায় ৩৫ শ্রমিককে নিয়ে ট্রলারডুবিতে ১৪ শ্রমিক সাঁতরিয়ে উঠলেও ৫ দিন ধরে ২০ শ্রমিক নিখোঁজ রয়েছেন। গতকাল শনিবারও দিনভর উদ্ধার অভিযান অব্যাহত রাখা হয়।
ঘাট সূত্রে জানা গেছে, ধলেশ্বরী, মেঘনা, শীতলক্ষ্যা ও বুড়িগঙ্গা নদী দিয়ে ৬ থেকে ৭ হাজার কার্গো ও বাল্ক্কহেড চলাচল করে। দিনের বেলায় বাল্ক্কহেড চলাচলে নিরাপদ হলেও রাতের বেলায় নৌ দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
মুন্সিগঞ্জ জেলা বাল্ক্কহেড মালিক সমিতির সভাপতি মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, সমিতি আছে, কার্যক্রম নেই। গত এক বছর আগে সমিতির সভায় রাতের বেলা বাল্ক্কহেড চলাচল বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছিল।
মুন্সিগঞ্জ জেলা প্রশাসক সায়লা ফারজানা বলেন, মেঘনা নদীর কয়েকটি স্থানে বালুমহাল ইজারা দেওয়া আছে। নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা তোয়াক্কা না করে রাতের বেলায় বাল্ক্কহেড চলাচল করছে। মাঝে মাঝে ভ্রাম্যমাণ আদালত শাস্তি ও জরিমানা করলেও তারা আইন অমান্য করেই চলছে। ইজারাদার ও বাল্ক্কহেড মালিক পক্ষকে নিয়ে সভা-সেমিনার করে সতর্ক করা হলেও পরে তারাই আইন অমান্য করে অবৈধ নৌযান চালাচ্ছে।