২৩শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
রবিবার | রাত ৪:১৪
দীঘিরপাড় ট্রান্সপোর্টের নৈরাজ্যে অতিষ্ঠ মুন্সিগঞ্জবাসী
খবরটি শেয়ার করুন:

ঢাকার খুব কাছের জেলা মুন্সিগঞ্জ। কিন্তু সেই কাছের জেলা যে কতটা দূরের হতে পারে, সেটা ঢাকা থেকে বাসে চড়ে না এলে বোঝা যেত না। জানা হতো না, রাজধানীর এত কাছের একটি জেলার মানুষের প্রধান সমস্যা জেলা সদরের সঙ্গে ঢাকার যাতায়াত।

ঢাকা থেকে মুন্সিগঞ্জে একটিমাত্র কোম্পানির বাস চলে। দীঘিরপাড় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেড নামের ওই বাস কোম্পানির মালিক টঙ্গিবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জগলুল হালদার ওরফে ভুতু। তিনি জেলা সড়ক পরিবহন সমিতিরও সভাপতি। অন্য কোনো কোম্পানির বাস এখানে চলতে গেলে তাঁর নেতৃত্বাধীন সমিতির অনুমতি লাগে। এমনকি বিআরটিসির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত (এসি) বাস চালুর এক দিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর সাত মাস পেরিয়ে গেছে, বিআরটিসি আর বাস নামাতে পারেনি।

মুন্সিগঞ্জের সাধারণ লোকজনের অভিযোগ, কোনো প্রতিযোগিতা নেই বলে সেবা হয়ে গেছে দয়াদাক্ষিণ্যের মতো। টিকিটের টাকায় নিশ্চিত যেটা কেনা হয়, তার নাম আসলে দুর্ভোগ। কয়েকজন নিয়মিত যাত্রী আফসোস করে বললেন, আগে রাজনীতির লোকেরা খেয়ে না-খেয়ে মানুষের সেবা করতেন। এখন যাঁরা রাজনীতি আর ব্যবসাকে একাকার করে ফেলেছেন; তাঁরা নিজের স্বার্থে জনগণকে কষ্ট দিতেও পিছপা হন না।

রাজধানীর আরেকটি কাছের জেলা নারায়ণগঞ্জ। নারায়ণগঞ্জ-ঢাকার মধ্যে বিআরটিসির এসি বাসসহ ১০-১২টি কোম্পানির বাস চলে। কিন্তু ব্যতিক্রম মুন্সিগঞ্জ।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, মুন্সিগঞ্জের এই সমস্যা অবশ্য নতুন নয়। এর আগে বিএনপি সরকার যখন ক্ষমতায় ছিল, তখন বিএনপির নেতাদের মালিকানাধীন ঢাকা ট্রান্সপোর্ট লিমিটেড ছাড়া এই পথে আর কোনো বাস চলত না।

গুলিস্তান থেকে সড়কপথে মুন্সিগঞ্জের দূরত্ব মাত্র ২৭ কিলোমিটার। প্রায় নিয়মিত ঢাকায় যাতায়াত করেন এমন কয়েকজন দাবি করলেন, ৬০ টাকা ভাড়া দিয়ে বাসে এই দূরত্ব পেরোতে গড়ে আড়াই ঘণ্টা সময় লাগে। যানজট থাকলে এ সময় আরও বাড়ে। কিন্তু এ সময় একটু আরাম করে বসারও সুযোগ নেই। কারণ দীঘিরপাড় ট্রান্সপোর্ট কোম্পানি লিমিটেডের মিনিবাসগুলো এতই ছোট যে পাশাপাশি দুজন যাত্রীর বসাই কষ্ট। এসব মেনেই প্রতিদিন হাজারো মানুষকে ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ যাতায়াত করতে হয়।

 

ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ বাস ভ্রমণ করে যাত্রীদের এসব অভিযোগের সত্যতা মিলল। বিশেষ করে সিটিং সার্ভিস হওয়ার পরেও দেখা গেল বিভিন্ন জায়গা থেকে যাত্রী তুলছেন চালকের সহকারী।

মুন্সিগঞ্জে গত চার দিনে সাধারণ যাত্রী, শিক্ষার্থী, আইনজীবী, সরকারি কর্মচারীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে কথা হয়। তাঁদের সবার কাছে প্রশ্ন ছিল—এই জেলার প্রধান সমস্যা কী? প্রায় সবার একটাই উত্তর, ঢাকায় যাতায়াত করাটাই তাঁদের প্রধান সমস্যা।

স্থানীয় ব্যক্তিরা জানালেন, পাঁচ বছর আগে যখন দীঘিরপাড় পরিবহন চালু হয়েছিল, তখন ভাড়া ছিল মাত্র ৩৫ টাকা। বছর বছর ভাড়া বেড়েছে। সর্বশেষ ৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে, কিন্তু সেবা বাড়েনি। আগে গাড়িতে ফ্যান ছিল, এখন কোনো ফ্যানও নেই। সব ফ্যান নষ্ট।

ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলার সভাপতি জাহাঙ্গীর সরকার বললেন, যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, সে দলের লোকজনের একটিমাত্র কোম্পানি ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ রুটে বাস চালায়। এর মধ্যে সেবা পাওয়া গেলেও তো হতো। কষ্ট পেতে হয় জনগণকে। সেবা ও প্রতিযোগিতা বাড়াতে হলে কয়েকটি কোম্পানিকে সুযোগ দেওয়া উচিত।

স্থানীয় প্রশাসনের বিভিন্ন পর্যায়ে কথা বলে জানা গেল, এলাকাবাসীর দাবির পরিপ্রেক্ষিতে এ বছরের ১৪ মার্চ ঢাকা-মুন্সিগঞ্জ সড়কে বিআরটিসির শীতাতপনিয়ন্ত্রিত বাস সার্ভিস চালু করা হয়। স্থানীয় সাংসদ মৃণাল কান্তি দাস, বিআরটিসির চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান ও জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান উপস্থিত থেকে সেবাটি চালু করেন। কিন্তু পরদিনই পুলিশ ও বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির লোকজন ঢাকায় ওই বাসের কাউন্টার বন্ধ করে দেয়। বলা হয়, বিআরটিসির এই রুটে বাস চালাতে হলে সড়ক পরিবহন সমিতির অনুমতি নিতে হবে।

জানতে চাইলে বিআরটিসির ব্যবস্থাপক আশরাফুল আলম বললেন, ‘মুন্সিগঞ্জবাসীর দাবি আর চাহিদার প্রেক্ষিতেই বাস সার্ভিস চালু করেছিলাম। কিন্তু পুলিশ ও বাস মালিক সমিতির আপত্তির কারণে আমরা ঢাকায় এই বাসের কাউন্টারই বসাতে পারিনি। বাস চালাতে হলে তো একটা ঠিকানা লাগবে, যেখান থেকে লোকজন বাসে উঠবে। কাউন্টার বন্ধ করে দেওয়ায় চালুর পরপরই সেবটি বন্ধ হয়ে গেছে।’ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান হওয়ার পরেও বিআরটিসি কেন এই পথে বাস চলাচলের অনুমতি পাচ্ছে না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা তো চেষ্টা করেছি। আপনারা তো সবই বোঝেন।

দীঘিরপাড় কোম্পানির চেয়ারম্যান জগলুল হালদার বললেন, ‘বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালুর দিন তো আমিও ছিলাম। তারা এত বড় বাস নামাল, এসি বাস; কিন্তু যাত্রী পায় না। তাই বন্ধ করে দিয়েছে।’ আপনার কোম্পানির সেবা নিয়ে তো অনেক অভিযোগ আছে।

জবাবে জগলুল হায়দার বলেন, ‘আমার বড় বাস সাতটা। আর ছোট বাস আছে ৩০-৩৫টা। ছোট বাসগুলোতে বসতে একটু কষ্ট হয়।’

অন্য কোম্পানির বাস এখানে চলে না কেন, জানতে চাইলে জগলুল হায়দার বলেন, ‘অন্য কোম্পানির বাস এসে তো থাকে না। বিআরটিসি এসি বাসই চালাতে পারল না। তবে আমিও মনে করি, এই রুটে ভালো এসি বাস নামানো উচিত। আমি জেলা প্রশাসক মহোদয়কে বলেছি, এসি বাস নামাতে চাই। ভাড়া একটু বাড়বে। কিন্তু তিনি কোনো সিদ্ধান্ত দেননি। আমি মনে করি মানুষ ১০ টাকা ৫ টাকা নিয়ে ভাবে না। একটু ভালো সার্ভিস চায়।’

জেলা প্রশাসক মো. সাইফুল হাসান বলেন, ‘যাত্রীদের সেবার কথা ভেবে বিআরটিসির বাস চালু করা হয়েছিল। কিন্তু রুট পারমিট নেই বলে সেই বাস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বিআরটিসির বাস আছে। তারা যেকোনো সময় বাস দিতে প্রস্তুত। কিন্তু বাস নামানো যাচ্ছে না।’

error: দুঃখিত!