মুন্সিগঞ্জ, ৮ মে ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুন্সিগঞ্জের বিভিন্নস্থানে ঘটে যাওয়া নির্মম গণহত্যার উপর নির্মিত নাটক ‘জেনোসাইড মুন্সিগঞ্জ’ মঞ্চস্থ হয়েছে।
গতকাল রোববার রাত ৮টা’র দিকে মুন্সিগঞ্জ শহরের সরকারি হরগঙ্গা কলেজ বধ্যভূমি স্মৃতিসৌধ প্রাঙ্গণে প্রায় ঘন্টাব্যাপী নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এতে জেলার অন্তত ৩০ জন নাট্যকর্মী অংশ নেন।
সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে নাট্যকার শিশির রহমানের রচনা ও নির্দেশনায় নাটকটি পরিবেশিত হয়।
নাটকটিতে দেখানো হয়- বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি নির্দেশে ২৫ মার্চ রাত ১০ টার মধ্যে গজারিয়ার বাউশিয়া ও মেঘনা ঘাটের ফেরিগুলো রামচন্দ্রপুর পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন স্থানীয় জনতা। ২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ পান মুন্সিগঞ্জের মুক্তিকামী মানুষ। এই সংবাদ শুনে জেলার আপামর জনতা দিনভর শহরে বিক্ষোভ করতে থাকেন। ওইদিন স্বাধীনতাকামী মানুষ হরগঙ্গা কলেজে জড়ো হয়ে পাকিস্তানি পতাকা নামিয়ে প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন।
অন্যদিকে শহরে মুন্সিগঞ্জ থানার সামনে বিক্ষুব্ধ জনতা বিক্ষোভ মিছিল করেন। স্থানীয় কয়েকজন যুবক পুলিশ স্টেশনের স্ট্যান্ডে বাঁধা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেন। ওই দিন দুপুরেই মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এবং মুক্তিকামী ছাত্র যুবক সম্মিলিতভাবে অস্ত্রের ট্রেজারী লুট করে ১৬০ টি রাইফেল আর বিপুল সংখ্যক গোলাবারুদ লুট করে স্থানীয় ছাত্র যুবকদের মধ্যে বিতরণ করেন। এটিই ছিল মুন্সিগঞ্জের মুক্তিপাগল যুবকদের প্রথম বিদ্রোহ, যা পকিস্তানি হানাদারদের টনক নড়িয়ে দিয়েছিল। সমবেত ছাত্র-জনতা শ্রীনগর, লৌহজং ও টংগীবাড়ী থানার রাইফেল ও গুলি লুট করে । সিরাজদিখান ও গজারিয়া থানার ওসি নিজে থেকেই মুক্তিকামী বিদ্রোহী যুবকদের অস্ত্র দিয়ে দেন। অস্ত্র হাতে পেয়ে যুবকরা মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট, সৈয়দপুর লঞ্চঘাট, আব্দুল্লাহপুর লঞ্চঘাট, তালতলা লঞ্চঘাট, গজারিয়া লঞ্চঘাট ও লৌহজং নৌবন্দরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় ব্যাপক গণহত্যা সংঘটিত হয়। ফলে ২৬ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ মুন্সিগঞ্জের দিকে আসতে শুরু করে। প্রায় প্রতিটি বাড়ি, স্কুল আর নদীর পাড়ের গ্রামগুলো হয়ে ওঠে শরণার্থী শিবির। একাত্তর সালে মুন্সিগঞ্জ ছিলো ঢাকা জেলার একটি মহকুমা। নদী বেষ্টিত গজারিয়া থানা মুন্সিগঞ্জের অন্তর্গত হলেও মূলত এটি ছিলো একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা।
৮ মে মধ্যরাতে একজন পাকিস্তানি মেজরের নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের দুই শতাধিক সৈন্য গজারিয়ায় অনুপ্রবেশ করে। পরদিন ৯ মে ভোর বেলায় ভয়াবহ অভিযান শুরু হয়। এটিই জেলার প্রথম গণহত্যা। ট্রেজারী লুটের ঘটনায় ১১ মে হানাদার বাহিনী মুক্তিকামী নেতা কর্মীদের বাড়িতে আগুন দেয়। এইদিন তারা পেট্রোল ঢেলে শহরের বেশ কয়েকটি হিন্দুপাড়াও জ্বালিয়ে দেয়। এর আগের দিন ১০ মে টংগিবাড়ী উপজেলার পালবাড়ি, ১২ মে সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়ার রামসিংয়ের বাড়ি ও ১৪ মে মুন্সিগঞ্জ সদরের মহাকালি ইউনিয়নে কেদার নাথ চৌধুরীর বাড়িতে ভয়াবহ গণহত্যা চালায়। ১২ মে থানায় থানায় ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে হানাদাররা পুরো মুন্সিগঞ্জকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে।
নাটক উপভোগ করতে জেলা প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ রাজনীতিক, শিক্ষক-ছাত্র, বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ ও শিল্প-সাহিত্য, সংস্কৃতি অঙ্গণের অনেকেই অংশ নেয়৷
এসময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন, স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মৃণাল কান্তি দাস, জেলা প্রশাসক কাজী নাহিদ রসূল, মুন্সিগঞ্জ সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ সুভাষ চন্দ্র হীরা, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট শীলু রায়, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক), আব্দুল কাদির মিয়া, সদর সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার থান্দার খায়রুল হাসান প্রমুখ।