ঈদুল আজহা মুসলমানদের প্রধান একটি ধর্মীয় উৎসব। এ উৎসব আরবি জিলহজ মাসের ১০ থেকে ১২ তারিখ পর্যন্ত (তিন দিন দুই রাত) উদ্যাপিত হয়ে থাকে। প্রাপ্তবয়স্ক যেকোনো মুসলমান নর-নারীর এ সময়ের মধ্যে ৫২ তোলা রুপার মূল্য পরিমাণ অতিরিক্ত যেকোনো ধরনের সম্পদ থাকলে তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব হয়। – বাদায়েউস সানায়ে ৪/১৯৬, রাদ্দুল মুহ্তার ৬/১৩২।
কোরবানি হলো, আরবি জিলহজ মাসের ১০, ১১ ও ১২ তারিখে আল্লাহর নামে হালাল পশু জবাই করা। আল্লাহপাকের নির্দেশে হযরত ইব্রাহিম (আ.) নিজের সবচেয়ে প্রিয় সম্পদ একমাত্র শিশুসন্তান হযরত ইসমাঈল (আ.)-কে কোরবানি করার প্রয়াসের মধ্যদিয়ে এক মহান ত্যাগের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। সেদিন আল্লাহ তায়ালার অসীম কৃপায় শিশু ইসমাঈল (আ.)-এর পরিবর্তে একটি দুম্বা কোরবানি হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে এরই ধারাবাহিকতায় হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নবুওয়াত প্রাপ্তির পর থেকে যেকোনো সক্ষম ব্যক্তির উপর তা ওয়াজিব হয়ে যায়। গৃহপালিত হালাল পশু যেমন- গরু, ছাগল, ভেড়া (বা দুম্বা), মহিষ, উট ইত্যাদি পশু ইখলাসের সঙ্গে নিয়ত করে সহিভাবে জবাইয়ের মাধ্যমে এ ওয়াজিব আদায় করা যায়। হযরত মুহাম্মদ (সা.) চার ধরনের ত্রুটিপূর্ণ পশু কোরবানি দিতে নিষেধ করেছেন : দৃষ্টিহীন (বা এক চোখ অন্ধ), রুগ্ণ, সম্পূর্ণভাবে খোঁড়া ও এতটাই শীর্ণকায় যে তার অস্থিতে অস্থিমজ্জা নেই।
নবীজীর দরবারে সাহাবায়ে কেরাম বলেন, ‘আমরা তো দাঁত, কান, লেজে ত্রুটিযুক্ত পশু দ্বারাও কোরবানি দিতে অপছন্দ করি। জবাবে, নবীজি বলেন, যা ইচ্ছা অপছন্দ করতে পারো; তবে তা অন্যের জন্য হারাম করো না।- সহিহ্ ইবনে হিব্বান ৫৯১৯, আবু দাউদ ২/৩৮৭, তিরমিজি ১/২৭৫। অনেকে মনে করেন, পশুর শিং অল্প ভাঙা থাকলে বা শিং উঠেনি, এমন পশু দ্বারা কোরবানি সহীহ হবে না; এ ধারণা ঠিক নয়। মূলত যে পশুর শিং একবারেই গোড়া থেকে ভেঙে গেছে, যার কারণে মস্তিষ্ক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা আছে, তা কোরবানি করা যাবে না। পক্ষান্তরে যে পশুর শিং আংশিক ভেঙে গেছে বা শিং উঠেনি, সে পশু দ্বারা কোরবানি করা যাবে।- তিরমিজি ১/২৭৬, আবু দাউদ ৩৮৮, রাদ্দুল মুহতার ৬/৩২৪।
মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও প্রতিবছর ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য মধ্য দিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করার পর পশু কোরবানি করে ঈদুল আজহা পালন করা হয়। কোরবানির জন্য জায়েজ পশুগুলোর মধ্যে গরুই সবচেয়ে বেশি কোরবানি দেয়া হয়। এ সময় গরুর দাম তুলনামূলকভাবে বেশি থাকায় ঈদকে সামনে রেখে গরু মোটাতাজাকরণ প্রক্রিয়া চলে খুব তোড়জোড়ে। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে গরু মোটাতাজাকরণের সুনির্দিষ্ট বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি (ইউএমএস পদ্ধতি) অনুসরণ করে এসব পশুর ওজন তিন-চার মাসে দেড় গুণ বৃদ্ধি করা সম্ভব, যা নিঃসন্দেহে লাভজনক ও স্বাস্থ্যসম্মত।
অতি মুনাফালোভী কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও কৃষক এ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অনুসরণ না করে ঈদের দু-তিন মাস আগে থেকে অতি সহজে তিন-চার গুণ ওজন বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে অতি উচ্চমাত্রায় ডেক্সামেথাসন গ্রুপের ডেকাসন ট্যাবলেট খাওয়ায় এবং অতিমাত্রায় বিভিন্ন ভিটামিন ও হরমোনাল ইনজেকশন দেয়। এ ছাড়া ভারত থেকে চোরাপথে আসা নিষিদ্ধ পাম নামক স্টেরয়েড ট্যাবলেট মাত্রাতিরিক্ত হারে গরুকে খাওয়ায়। এসব ক্ষতিকর স্টেরয়েডের কারণে গরুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে কমে যায়। অনেক ক্ষেত্রে অধিক মাত্রায় হরমোন প্রয়োগের কারণে গরুর ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন ধরনের জটিল রোগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া এসব গরুর কিডনি অতি দ্রুত অকার্যকর হতে থাকে। ফলে শরীরে কোষের মধ্যে পানির পরিমাণ বেড়ে যায় এবং দ্রুত কোষ বিভাজন হতে থাকে। এ কারণেই দৃশ্যত গরু অধিক মোটাতাজা দেখায়। প্রকৃতপক্ষে এসব গরুর গোশতের গুণগত মান মারাত্মকভাবে কমে যায়। এসব গরুর গোশত খাওয়ার পর তাৎক্ষণিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেখা না গেলেও ধীরে ধীরে মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। ফলে বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগের সৃষ্টি হয়।
অত্যাধিক মোটাতাজা, নাদুস-নুদুস গরু-ছাগল সস্তা দামে পেলেও তা ক্রয় করা ঠিক হবে না। এর আগে যতটা সম্ভব যাচাই-বাছাই করে নিতে হবে। অত্যাধিক মোটাতাজা পশু, যার শরীরে আঙুল দিয়ে চাপ দিলে দেবে গিয়ে ছোট গর্তের মতো সৃষ্টি হয়ে খানিকটা স্থায়ী হয়, তেমন একটা নড়াচড়া করে না, জাবর কাটে না, চক্ষুযুগল অনুজ্জ্বল দেখায়- এমন পশুই ক্ষতিকারক ওষুধ ব্যবহার করে মোটাতাজা করা হয়েছে বুঝতে হবে। তাই অধিক মোটাতাজা পশু ক্রয় না করাই উত্তম।
কোরবানির পশু ক্রয়ে যে বিষয়গুলো বিবেচনা করতে হবে:
১. পশু সর্বদাই লেজ নাড়িয়ে মশা-মাছি তাড়াতে ব্যস্ত থাকবে ও কিছুক্ষণ পর পর নড়াচড়া করবে।
২. খাবার দিলে তা স্বাভাবিকভাবে খাবে ও অবসর সময়ে জাবর কাটবে।
৩. চোখ বড় ও উজ্জ্বল দেখাবে।
৪. নাকের নিচের কালো অংশ (মাজল) ভেজা ভেজা থাকবে, মনে হবে যেন ফোঁটা ফোঁটা শিশির জমেছে।
৫. শ্বাসপ্রশ্বাস স্বাভাবিক থাকবে, অস্বস্তিতে ছটফট করবে না।
৬. গরু-মহিষের ক্ষেত্রে বয়স দুই বছরের বেশি এবং ছাগল-ভেড়ার ক্ষেত্রে এক বছরের বেশি হতে হবে।
৭. সম্ভব হলে পশুর প্রস্রাব ও গোবর স্বাভাবিক কি না তা যাচাই করতে হবে।
৮. গর্ভবতী স্ত্রী পশু কোরবানি না করাই উত্তম।
৯. পশুর চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করা উচিত।
হযরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, আমরা যেন কোরবানির পশুর চোখ ও কান ভালোভাবে লক্ষ করি এবং ওই পশু দ্বারা কোরবানি না করি যার কানের অগ্রভাগ ও পশ্চাতভাগ কর্তিত।- আবু দাউদ ২/২৩৮, তিরমিজি ১/২৭৫।
আজকাল বিত্তবান লোকদের মধ্যে কে কত বেশি দামের পশু ক্রয় করতে পারে বা কার কোরবানির পশু কত বড়- এ নিয়ে নোঙরা প্রতিযোগিতা চলে। কোনো কোনো সময় এ ধরনের নজরকাড়া পশু এলাকায় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে প্রদর্শন করা হয়, পত্র-পত্রিকায় ফলাও করে ছাপা হতেও দেখা যায়- যা চরম মূর্খতা ও পাপাচার ছাড়া আর কিছুই না। এ ছাড়া এসব পশু যে অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক ঔষধ ব্যবহার করে মোটাতাজা করা হয়নি, তার নিশ্চয়তাই বা কতটুকু? তাই এ ক্ষেত্রে বেশি মূল্যের একটা পশুর পরিবর্তে অপেক্ষাকৃত কম মোটাতাজা কয়েকটি পশু কোরবানি দেওয়া যেতে পারে। পশু কোরবানি কোনো আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এতে নিজের বড়ত্ব প্রকাশ, বাহবা পাওয়া ও লোক দেখানো মনোভাব থাকলে ওই ইবাদত কবুল হবে না।
পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘এগুলোর (কোরবানির) গোশত, রক্ত কোনটাই আল্লাহর নিকট পৌঁছে না, পৌঁছে শুধু তোমাদের (বান্দাদের) তাকওয়া।’- সুরা হজ, আয়াত ৩৭।
সুতরাং এ ক্ষেত্রে সবর্স্তরের মানুষের সচেতন হওয়া অত্যন্ত জরুরি। এভাবে মানুষের স্বাস্থ্যহানি ঘটানো বা মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেওয়া যে মারাত্মক পাপ, তা এসব অসৎ ও মুনাফালোভী ব্যবসায়ীদের বুঝতে হবে ও সতর্ক করতে হবে।
এসব ব্যবসায়ীর বিরুদ্ধে প্রশাসনের নজরদারি জোরদার করা এবং যুগোপযোগী আইন প্রণয়ন ও প্রয়োগের মাধ্যমে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা খুবই জরুরি। মসজিদের সম্মানিত ইমাম-খতিবগণ জুমার নামাজের আগে বিশেষভাবে এ বিষয়ে আলোচনা করেও জনসচেতনতা তৈরিতে ভূমিকা পালন করতে পারেন।
লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান
জেনেটিঁক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগ
হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।