মুন্সিগঞ্জ, ১৫ নভেম্বর ২০২৩, নিজস্ব প্রতিনিধি (আমার বিক্রমপুর)
আলোচিত-সমালোচিত চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের নজর পড়েছে এবার মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার চরকিশোরগঞ্জ (মোল্লারচর) এলাকায়। সেখানকার ধলেশ্বরী তীরে শিপইয়ার্ড গড়ে তোলেছেন তিনি।
সম্প্রতি তিনি ফসলি জমির উপর দিয়ে শিপইয়ার্ডে যাতায়াতের জন্য শুরু করেছেন দীর্ঘ সড়ক নির্মাণ। অন্তত ১০ টি পরিবারের জমি দখল করে কয়েকদিন আগে বালু ভরাট করছেন আওয়ামী লীগ দলীয় এ সংসদ সদস্যের লোকজন।
সংসদ সদস্যের হয়ে জমি দখল ও বালু ভরাটের সাথে জড়িত রয়েছেন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। সেখানে ড্রেজারের পাইপ স্থাপন করে গেলো শুক্রবার থেকে শুরু হয়েছে বালু ভরাট। এক সপ্তাহের ব্যবধানে ভুক্তভোগী পরিবারের লোকজন জমি দখল ও বালু ভরাটের পায়তারার ঘটনায় মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও পুলিশ উল্টো ভুক্তভোগীদের শাসালেও অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
ভুক্তভোগী পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ৩ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. মকবুল হোসেন ড্রেজার দিয়ে সংসদ সদস্যের শিপইয়ার্ডে যাতায়াতের ওই সড়ক নির্মাণ করে দিচ্ছেন। একই সঙ্গে পৌরসভার উত্তর ইসলামপুর এলাকার প্রয়াত আব্দুল খালেকের ছেলে আনোয়ার মুন্সী জমি দখলে সংসদ সদস্যের পক্ষে মূখ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন।
জানা গেছে, ২০১৬ সালে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার চরকিশোরগঞ্জ এলাকার ধলেশ্বরী নদীর তীরে দুই থেকে আড়াই একর জমি কিনে গ্লোব শিপইয়ার্ড নামে একটি জাহাজ নির্মাণ প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফ। শিপইয়ার্ড গড়ে তোলার শুরু থেকেই ধলেশ্বরী তীরে নানাভাবে স্থানীয়দের জমি দখলে নিতে মত্ত হয়ে উঠেন এ সংসদ সদস্য। বর্তমানে তার শিপইয়ার্ডের জমির পরিমাণ বেড়েছে কয়েক গুন। স্থানীয়দের মতে এখন তার জমির পরিমান দাঁড়িয়েছে ৮ থেকে ৯ একর।
তাদের অভিযোগ, এসব জমির বেশির ভাগই অশুভ পন্থায় কিংবা দখল করে নেওয়া হয়েছে। সংসদ সদস্যের এহেন কর্মকান্ডে রীতিমতো রাতের ঘুম হারাম হয়ে গেছে ধলেশ্বরী তীরের চরকিশোরগঞ্জ এলাকার বাসিন্দাদের।
জমি দখলে নিতে সংসদ সদস্যের প্রধান অস্ত্র হচ্ছে থানায় স্থানীয়দের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজির মামলা করা। ২০১৯ সালে গ্লোব শিপইয়ার্ডের প্রজেক্ট ম্যানেজার যুবায়ের হোসেন বাদী হয়ে স্থানীয় ১০ জনকে আসামি করে সদর থানায় চাঁদাবাজির মামলা দায়ের করেন। একই ঘটনায় আদালতেও সংসদ সদস্যের পক্ষে আলম মাদবর নামে এক ব্যক্তি স্থানীয় ২০-২৫ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। এতে স্থানীয়রা তার সঙ্গে পেরে উঠতে পারছেন না। আর সেই সুযোগে জমি দখলে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেন সংসদ সদস্য। বাড়তে থাকে শিপইয়ার্ডের পরিধি। এরপর চলতি বছরের অক্টোবরে শিপইয়ার্ডে যাতায়াতের জন্য এলাকার প্রধান সড়ক থেকে ধলেশ্বরী তীরে যেতে দীর্ঘ সড়ক নির্মাণে মনোযোগী হয়ে উঠেন সংসদ সদস্য। ওই সড়ক নির্মাণের লক্ষ্যে অন্তত ১০ টি পরিবারের জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণে বালু ভরাটের পায়তারা চালাতে থাকেন। সংসদ সদস্যের সড়ক নির্মাণ বন্ধে জমির মালিকরা দ্বারস্ত হন সদর থানায়।
চরকিশোরগঞ্জ এলাকার আলী আকবর আনোয়ার তার বাড়ি সংলগ্ন জমি দখল ও বালু ভরাটের বিরুদ্ধে ২৯ অক্টোবর সদর থানায় লিখিত অভিযোগ দায়ের করেন। এরপর কহিনুর বেগম ও মো. মোফাজ্জল হোসেন তাদের পৈত্রিক সম্পত্তি দখলে নিয়ে বালু ভরাটের পায়তারার অভিযোগ এনে থানায় লিখিত পত্র দেন। অভিযোগ পেয়ে সদর থানার ওসি তদন্তের ভার দেন এসআই এনামুল মন্ডলকে। এসআই এনামুল সরেজমিনে ওই এলাকায় গিয়ে উল্টো ভুক্তভোগীদের শাসিয়ে আসেন। আর সেই সুযোগে গত ১০ নভেম্বর স্থানীয়দের জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মানে বালু ভরাট শুরু করেন সংসদ সদস্যের লোকজন।
ভুক্তভোগী কোহেনুর বেগম বলেন, আমার বাবার ১৩০ শতাংশ জমি আছে। আমরা পাচঁ বোন ও এক ভাই। আমরা কোন জমি বিক্রি করি নাই। কিন্তু এমপি লতিফ ও তার গুন্ডা বাহিনী মিলে জমিটির দখল নেয়। আমরা সবাই মিলে সদর থানায় কয়েকবার লিখিত অভিযোগ দায়ের করি। পুলিশ আসে আবার চলে যায়। কিন্তু তারা দখল ঠেকাতে পারে না। এসব জমির উপর আমাদের সকলের সংসার চলে। এটা আমাদের তিন ফসলি জমি।
জমির মালিক আমির হোসেন বলেন, উত্তর ইসলামপুর এলাকার আনোয়ার মুন্সী উরফে ঠেলাগাড়ি আনোয়ার ও আলম মাদবরসহ আরও কয়েকজন মিলে আমাদের জমিগুলো দখল করিয়ে দেয়। থানায় গেলে পুলিশ বলে উপরের নির্দেশ আছে আমাদের কিছু করার নেই। আমারা কয়েকবার বাঁধা দিতে গিয়েছি। সেখানে ওদের পক্ষের লোকজন মিলে আমাদের মারধর করে আবার পুলিশ এনে আমাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার হুমকি দেয়। পুলিশ গিয়ে শান্তির কথা বলে কেউ এখানে কাজ করতে পারবে না বলে আমাদের ফিরিয়ে আনে। পরে পুলিশের সহযোগীতায় তারা আমাদের জমিগুলো ভরাট করে আসছে।
ভুক্তভোগী মো. আলী আকবর বলেন, আমি এখানে কোম্পানী হওয়ার আগে ৭০ শতাংশ জমি ক্রয় করি। কিন্তু না জানিয়ে আমার জমি ভরাট করে ফেলতেছে। কয়েক দফা বাঁধা দিয়েছি। পুলিশ আমার পক্ষ না নিয়ে ওদের পক্ষ নেয়। আমার জমিতে আমি যেতে পারিনা। আমার বিরুদ্ধে একটি চাদাবাজির মামলা দিয়েছে। বর্তমানে আমি জামিনে রয়েছি। জমিতে গেলো আমার বিরুদ্ধে পুলিশ লাগিয়ে দেয়। আমাকে এমপি লতিফ কয়েকবার ফোন করেছিল। তিনি আমাকে ভয়ভীতি দেখায়। তার ছেলেও আমাকে ভয় দেখায়।
বছিরুন নেছা বলেন, আমি খুব অসুস্থ। আমার জমির পরিমান ৬৫ শতাংশ। এই জমি আমার কাছ থেকে কোম্পানী কোনভাবেই কিনে নেয়নি। তারপরও আমার জমি দখল করে নিয়েছে এমপি লতিফ ও তার গুন্ডা বাহিনী। কারো কাছে বিচার পাচ্ছি না। আদালতে মামলা দিতে গেলে অনেক টাকা প্রয়োজন। আমারা কৃষক মানুষ, কোথা থেকে এতো টাকা পাবো। অনেক বার পুলিশের কাছে গিয়েছিলাম, তারা আমাদের কথা শোনে না, এমপির কথা শুনে। আমাদের বলে চুপ করে বসে থাকেন।
অন্যদিকে, মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার উত্তর ইসলামপুর এলাকার আনোয়ার মুন্সী উরফে ঠেলাগাড়ি আনোয়ার এক সময় মাটি টানার ভ্যান গাড়ি চালাতো। এমপি লতিফের হয়ে ধলেশ্বরী তীরের জমি দখল করে দিয়ে এখন সে কোটিপতি। সাধারণ কৃষকদের ভুল বুঝিয়ে বিভিন্ন পন্থায় টাকা ছাড়া কিছু জমি নিজের নামে করে নেয়। এরপর এমপি লতিফ ও পুলিশের একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তার ছত্রছায়ায় মানুষের জমি না কিনে দখল নিতে থাকে। কেউ বাধাঁ দিতে গেলে তাদের বিভিন্ন মামলা দিয়ে জমি দখল করে নেয়।
সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের জমি দেখভাল করে থাকেন আনোয়ার মুন্সী। মোবাইল ফোনে তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, আমি কোনো মতেই জড়িত নই। বালু ভরাট কাজ করছেন পৌর কাউন্সিলর মকবুল হোসেন।
পরে কাউন্সিলর মকবুল হোসেনের মোবাইল ফোন নাম্বারে সাংবাদিকরা একাধিকবার কল করলেও তিনি কল গ্রহণ করেননি।
এবিষয়ে পুলিশ সুপার মো. আসলাম খান বলেন, জমি-জমা সংক্রান্ত ঝামেলা ভূমি অফিস অথবা জেলা প্রশাসন দেখে থাকে। তবে আইন-শৃঙখলার কোন বিষয় থাকলে সেটা আমরা আন্তরিকতার সঙ্গে দেখবো।
জমি দখল ও সড়ক নির্মাণে বালু ভরাট প্রসঙ্গে জানতে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এমএ আব্দুল লতিফের ব্যবহৃত মোবাইল ফোন নাম্বারে একাধিকার কল করা হলেও তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
পরে তার ছোট ছেলে ওমর খৈয়ামের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা হয়। এসময় তিনি বলেন, এ বিষয় নিয়ে আমি আমার বাবার সাথে কথা বলেছি। যারা আমাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলেছে। আব্বু তাদের বলেছে তোমাদের কাগজপত্র সঠিক থাকলে আমাদের কাছে নিয়ে আসো। তোমাদের হক আমরা মেরে খাবো না। আব্বু বলেছেন, স্থানীয় এক কাউন্সিলরের সাথে কথা হয়েছে। তাদের নিয়ে বসেন। আমরা আমাদের কাগজপত্র সঠিক রেখেই কাজ করেছি। আমাদের অনেক জমি কেনা আছে। আপনারা দেখেন, যাচাই-বাছাই করুন।