পোশাক শিল্পপার্ক স্থাপনের জন্য এক যুগেরও বেশি সময় ধরে দাবি করে আসছিল পোশাক শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ। এ জন্য ২০০১ সালে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়ায় গার্মেন্ট শিল্পপার্ক নামে একটি প্রকল্প অনুমোদন দেয় সরকার। কিন্তু দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই সেই ‘স্বপ্নের’ পোশাক পল্লীর। তবে আগামী সপ্তাহে চীনা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং করপোরেশন লিমিটেডের (ওআইএইচ) সঙ্গে বৈঠক করবে বিজিএমইএ। যার সঙ্গে আগেই চুক্তি ছিল বিজিএমইএ’র। ওই বৈঠকে প্রকল্প নিয়ে যে অনিশ্চয়তা ছিল তা দ্রুতই সমাধান হবে বলে বিজিএমইএ সূত্রে জানা গেছে।
সূত্র মতে, ২০০১ সালে একনেক বৈঠকে গার্মেন্ট শিল্পপার্ক প্রকল্পটি অনুমোদিত হয়। এর পর পার্কটি কোথায় হবে তা নিয়ে মতভেদ দেখা দেয় সরকার ও উদ্যোক্তাদের মধ্যে। এর ৬ বছর পর ২০০৬ সালে মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া উপজেলার বাউশিয়া মৌজায় ‘গার্মেন্টস শিল্পপার্ক’ স্থাপনের জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। স্থানটি পছন্দ হওয়ায় মুন্সীগঞ্জের জেলা প্রশাসক প্রস্তাবিত জমি চিহ্নিত করে জমির দাগ, মৌজা ও সাইট ম্যাপ তৈরি করেন। পরে এটি বিনিয়োগ বোর্ডের মাধ্যমে বিসিকের কাছে পাঠানো হয় এবং সে মোতাবেক প্রকল্প প্রণয়ন করা হয়। ২০০৭ সালে এ বিষয়ে বিসিক ও বিজিএমইএ’র মধ্যে সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। সরকারের কোন্ বিভাগ এটি বাস্তবায়ন করবে, অর্থের উৎস কি হবে- এমন অনেক বিষয় নিয়ে বছরের পর বছর বিভিন্ন পর্যায়ে বৈঠক ও দেন-দরবার হলেও এখন পর্যন্ত এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো যায়নি। আর এ জন্য বিজিএমইএ’র আন্তরিকতাকে দায়ী করছেন সংশ্লিষ্টরা। অথচ সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিজিএমইএ এবং চীনা প্রতিষ্ঠান ওরিয়েন্টাল ইন্টারন্যাশনাল হোল্ডিং করপোরেশন লিমিটেডের (ওআইএইচ) যৌথ উদ্যোগে বাউশিয়ায় এই প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা ছিল। এ লক্ষ্যে বিজিএমইএ’র সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের মধ্যে একটি সমঝোতা চুক্তিও হয়েছিল। এখন বিজিএমইএ’র অসহযোগিতার কারণে প্রকল্পটির বাস্তবায়ন অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। যা এখন আলোর মুখ দেখতে পাবে বলে মনে করা হচ্ছে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, ভাড়াটে কিংবা অংশীদারী ভবনে কারখানা রয়েছে, এমন পোশাক কারখানা মালিকদের জন্য এই গার্মেন্টস পল্লী নির্মাণ করা হবে। তাই গার্মেন্টস পল্লী স্থানান্তরে বড় বড় গার্মেন্ট কারখানা মালিকদের আগ্রহ কম।
সূত্র জানায়, গার্মেন্ট মালিকরা নিজেদের অর্থে কেনা জমিতে বাউশিয়ায় কারখানা করতে চান না। এ ক্ষেত্রে তারা সরকারের অর্থায়ন চান। কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমাধান হয়নি, কোথা থেকে এই অর্থ আসবে। এসব কারণে রাজধানী থেকে গার্মেন্ট শিল্প মুন্সীগঞ্জে স্থানান্তর অনেকটাই অনিশ্চিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
জানা গেছে, প্রায় এক দশক আগে এ প্রকল্পটি নেয়া হলেও ২০১৩ সালে এসে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে নতুন মাত্রা যুক্ত হয়। ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে ৫৩০.৭৮ একর জমি অধিগ্রহণের জন্য প্রশাসনিক অনুমোদন দেয় সরকার। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বাউশিয়া, মধ্যম বাউশিয়া, পোড়ারচক, কাইচখালী ও চৌদ্দকাহনিয়া মৌজায় ৪৯২ একর জমি অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া চূড়ান্ত করে। ২০১৩ সালে তিন বার এবং ২০১৪ সালে চতুর্থবার জমির দাম ও ক্ষতিপূরণ বাবদ ৭৭৭ কোটি ৮৩ লাখ টাকা নির্ধারণ করে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে জমা দিতে বিজিএমইএকে নোটিশ দেয়া হয়। কিন্তু বিজিএমইএ টাকা না দেয়ায় অধিগ্রহণ প্রক্রিয়া বাতিল করে মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। এরপরও প্রায় তিন বছর পেরিয়ে গেছে। ইতিমধ্যে ওই এলাকার জমির দামও দ্বিগুণ হয়েছে। ফলে বিজিএমইএ’র সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের যে সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল, সে অনুযায়ী চীনা প্রতিষ্ঠানটির করা অর্থায়নে এখন প্রকল্প বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়েছে। কারণ খরচ বেড়ে গেছে কয়েকগুণ।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, বাউশিয়া প্রকল্পের কার্যক্রম বর্তমানে খুবই ধীরগতিতে এগোচ্ছে। চীনা প্রতিষ্ঠানটি এই প্রকল্পে কিভাবে কোন শর্তে অর্থ বিনিয়োগ করতে চায়, তা আমাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তাই এর কোনো অগ্রগতি নেই।
জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চীন সফরকালে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ওআইএইচের সঙ্গে ২০১৪ সালের ১০ই জুন সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে বিজিএমইএ। ২০১৪ সালের ১৩ই ডিসেম্বর বিজিএমইএ’র সঙ্গে চীনা প্রতিষ্ঠানটির একটি কাঠামোগত চুক্তি স্বাক্ষর করা হয়। তাতে শিল্পপার্কটি স্থাপনে ব্যয় ধরা হয় ২৩০ কোটি ডলার, যার পুরোটাই বিনিয়োগ করার কথা চীনা কোম্পানির। শিল্পপার্ক প্রতিষ্ঠার পর গার্মেন্ট মালিকদের কাছে প্লট বিক্রি করে এবং বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ভাড়া আদায় করে বিনিয়োগের সঙ্গে মুনাফার পরিকল্পনা ছিল চীনা প্রতিষ্ঠানটির। কিন্তু নানা কারণে চীনা প্রতিষ্ঠানের মনে হয়েছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের পর পোশাক শিল্প মালিকরা এখানে প্লট নাও কিনতে পারেন। যে কারণে চীনা প্রতিষ্ঠানটিও বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে বলে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট ওই সূত্র।
সূত্র জানায়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে শিল্পপার্কে ৩০০ থেকে ৫০০টি তৈরি পোশাক কারখানা নির্মাণ করা হবে। এখানে ২ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক কাজ করার সুযোগ পাবেন। তৈরি পোশাক কারখানার পাশাপাশি পাঁচ তারকা হোটেল, শ্রমিক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বসবাসের সুবিধা, বিদ্যুৎ, পানি, গ্যাস, পার্কিংসহ শিল্প-কারখানায় প্রয়োজনীয় সব ধরনের অত্যাধুনিক সুযোগ-সুবিধা থাকবে। পার্কটিতে যেসব কারখানা গড়ে ওঠার কথা, তাতে বছরে ৩০০ থেকে ৫০০ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি করা সম্ভব হবে।
বিজিএমইএ সহ-সভাপতি মোহাম্মদ নাসির বলেন, অনেক আগেই পোশাক পল্লী নিয়ে চীনা একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিজিএমইএ’র সমঝোতা চুক্তি হয়েছিল। সেই প্রতিষ্ঠানের একটি প্রতিনিধি দল বাংলাদেশে অবস্থান করছে। আগামী সপ্তাহে বিজিএমইএ’র সঙ্গে বৈঠকে বসার কথা রয়েছে। তিনি বলেন, তারা অর্থ ছাড় দেয় নাই বলেই প্রকল্পটি অনেকটা অনিশ্চতায় পড়ে ছিল। কিন্তু আগামী সভায় সেটা নিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আসতে পারে বলে তিনি জানান।