বিশেষ প্রতিবেদকঃ মুন্সীগঞ্জ শহরের কাছের চরমুক্তারপুরে ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরী অনবরত পরিবেশ দূষণ করে চলেছে।ঐতিহ্যবাহী নদীটির বহু জলজ প্রানীগুলোর অবস্থাও এখন বিপন্ন। সিমেন্ট ফ্যাক্টরী’র প্রভাবে এখানে হলুদ বৃষ্টির ঘটনা পর্যন্ত ঘটছে।
আশপাশের জমিজমার উর্বরতা হ্রাস পাচ্ছে। গাছপালাগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। শাহ্ সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, ক্রাউন সিমেন্ট, আল্ট্রাটেক সিমেন্ট (পুরনো নাম আমিরাত সিমেন্ট) ও মেট্রোসেম সিমেন্ট গড়ে উঠেছে ধলেশ্বরী ও শীতলক্ষ্যার তীর ঘেষে।
প্রতিদিন প্রায় ৬ হাজার বস্তা সিমেন্ট উৎপাদনের ধারণ ক্ষমতার এই ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরী লাখ লাখ টন ক্লিংকার জাহাজ থেকে খোলা ক্রেনে করে অপসারণ করছে। এই ক্লিংকারের ডাস্ট উরে গিয়ে পড়ছে নদী, জমি, বাড়িঘরে। মানবদেহের ক্ষতি করছে মারাত্মকভাবে। যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহন না করে কর্মরত থাকায় এই সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলোতে কর্মরত প্রায় চার হাজার শ্রমিক ভুগছেন নানা রোগে। মুন্সীগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. শহিদুল ইসলাম আমার বিক্রমপুর কে জানান, শুধু শ্রমিকরাই নন এই অঞ্চলে বসবাসরতরা ফুসফুসের বিভিন্ন রোগে ভুগছে। মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক ক্লিংকারের ফ্লাই এ্যাশ এ্যাজমা, শ্বাশকষ্টসহ ফুসফুসজনিত নানা রোগের কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। তাই ক্রমেই এই অঞ্চলে এই রোগীর সংখ্যা বাড়ছে। এ সংক্রান্ত শিশু রোগীও আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
মুন্সীগঞ্জ পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক ধলেশ্বরী তীরের সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলোর পরিবেশ দূষনের সত্যতা স্বীকার করে জানান, শাহ্ সিমেন্ট ও ক্রাউন সিমেন্টসহ কায়েকটি সিমেন্ট ফ্যাক্টরীকে সম্প্রতি প্রায় ৫৮ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। তাদের কাজ কর্ম মনিটর করা হচ্ছে। পরিবেশ দূষণের সার্বিক চিত্র তুলে ধরে উধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে রিপোর্ট প্রেরণ করা হয়েছে। দূষণরোধে সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহন করা হবে।
অন্যদিকে প্রিমিয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরী চীফ কো অর্ডিনটর কমান্ডার (অব) রেজাউল করিম বলেন, “কল কারখানা থাকলে কিছুটা পরিবেশ দূষণ হবেই। কিন্তু তা সহনীয় পর্যায়ে কিনা সেটাই বিবেচ্য বিষয়। প্রতি বস্তায় ৬২ টাকা সরকারকে ট্যাক্স দেয়া হচ্ছে। সিমেন্ট ফ্যাক্টরী থেকে তেমন কোন দূষণ হয়না। এর কোন তরল কোন বর্জ্য নেই। তবে ক্লিংকারের ডাস্টগুলো ডাস্ট কালেক্টর দিয়ে সাধ্য অনুযায়ী প্রতিরোধ করা হচ্ছে। ক্লিংকারের নদীর তলদেশ ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার অভিযোগও ঠিক নয়, কারণ ড্রেজিং করে নাব্যতা বজায় রাখা হয়। নয়তো জাহাজ আসতে পারছে না।” তিনি দাবী করেন-“ সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে যে ক্ষতি হয়। তা ঢাকা শহরের যান বাহনের দূষণের চেয়ে অনেক কম। ফ্লাই এ্যাশ প্রতিরোধে গাছপালা লাগানো হচ্ছে, বনায়ন করা হচ্ছে।”
ইতোমধ্যে ধলেশ্বরীর পানি দূষিত হয়ে নিকষ কালো রং ধারণ করেছে। মিরকাদিম নদী বন্দর ঘাট থেকে শুরু করে শহরের কাছে চরকিশোরগঞ্জ এলাকা পর্যন্ত দীর্ঘ চার কিলোমিটার এলাকায় ধলেশ্বরী নদীর পানি থেকে দুগন্ধ ছড়াচ্ছে। পানি ব্যবহারের অনুপযোগী হয়ে পড়ায় নদী পাড়ের বাসিন্দাদের গোসল করার ক্ষেত্রে হচ্ছে সমস্যা। জেলেরা এখন আর এ নদীতে মাছ শিকারে আসে না। আগে নদীতে কিছু সময় পরপর শুশুম মাছ ভেসে উঠতো। তা আবার ডুবে যেতো। কিন্তু সেই শুশুম মাছ তথা ডলফিন মাছ এ নদীতে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সিমেন্টের ফ্লাই অ্যাশ ও বিভিন্ন কারখানার বর্জ্য ধলেশ্বরীকে বিপন্ন করে তোলছে।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) মুন্সীগঞ্জ জেলার সভাপতি এ্যাডভোকেট মুজিবুর রহমান জানান, টেক্সটাইল, ডাইং মিল ও সিমেন্ট তৈরির ফ্যাক্টরীর বিষাক্তবর্জ্য তথ্য ফ্লাই এ্যাশ এই অঞ্চলের পরিবেশ মারাত্মকভাবে বিনষ্ট করছে। ফ্যাক্টরী গুলোর বর্জ্য পরিশোধিত ট্রিমেন্ট প্লান্ট (ইটিপি) ব্যবহার না সরাসরি ওই বিষাক্ত বর্জ্য নদীতে পরছে। তাছাড়া সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলোর অ্যাশ উড়ে সরাসরি নদীতে গিয়ে পড়ছে। সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে খোলা মেলাভাবে ক্লিংকার ও অ্যাশ জাহাজে লোড-আনলোড করা হচ্ছে। সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর অ্যাশ দ্বারা আশাপাশের সমস্ত এলাকা অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে।
সিমেন্টের অ্যাশ উড়ে এসে শহর লাগোয়া ধলেশ্বরী নদীর তীরবর্তী হাটলক্ষীগঞ্জ, নয়াগাঁও, মীরেশ্বরাই, মুক্তারপুর, চরমুক্তারপুর এবং খোদ জেলা শহর মুন্সীগঞ্জ ও আশপাশ এলাকার পরিবেশ দূষণ করে চলছে। মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী ছিল কর্ম-ব্যস্ত। কার্গো আর হুইসেলের শব্দে ছিল মুখরিত। দেশের দক্ষিণবঙ্গসহ বিভিন্ন জেলা থেকে ধান-চাল বোঝাই করে আসতো বড় বড় পালতোলা নৌকা। ধলেশ্বরী নদীর তীরে দ্বিতীয় কলকাতা খ্যাত মিরকাদিম নদী বন্দরে আসতো-যেতো ওইসব পালতোলা নৌকা, স্টীমার-কার্গো। ধান-চালের মহাজনদের ভিড়ে দিন রাত মুখরিত থাকতো এ নদী। কিন্তু এখন আর সেই কোলাহল-হুইসেলের শব্দ নেই। সময়ের বিবর্তনে থমকে গেছে মিরকাদিম নদী বন্দরের পুরণো কর্ম-চঞ্চল্যতা। সেই সঙ্গে মুন্সীগঞ্জ শহরতলী লাগোয়া ধলেশ্বরী নদী এখন আর আগের মতো মুখর হয়ে উঠে না। স্বচ্ছ-টলটলে পানিও দুষিত হয়ে গেছে।
মুন্সীগঞ্জের চরমুক্তারপুরে বিভিন্ন টেক্সটাইল মিলসের কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য সরাসরি নদীতে ফেলে বায়ু দূষণ করে চলেছে। মুক্তারপুর ও চরমুক্তারপুরে সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর অ্যাশ ও ডাইং ও প্রিন্টিংসহ অংসখ্য শিল্প প্রতিষ্ঠান পানি ও বায়ু দূষণ করে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন করে তুলেছে। সিমেন্ট, টেক্সটাইল ও ডাইং ফ্যাক্টরীর অ্যাশ ও বিষাক্ত বর্জ্যে আক্রান্ত হয়ে পড়েছে মুন্সীগঞ্জের ধলেশ্বরী নদী। গত বছরের ২ জুলাই চর মুক্তারপুরে আইডিয়েল টেক্সটাইল মিলস ও বর্ণালী ফ্রেবিক্সকে কেমিক্যাল মিশ্রিত তরল বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় মাটির নীচে নির্মিত পাইপ লাইনের মাধ্যমে সরাসরি ধলেশ্বরী নদীতে ফেলার অভিযোগে ৩৮ লাখ ৪০ হাজার টাকা জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। ওই সময় পূর্ণাঙ্গভাবে পানি পরিশোধন প্লান্ট (ইটিপি) স্থাপন না করা পর্যন্ত ডাইং ও প্রিন্টিং কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়। এর পর আর মুক্তারপুরে টেক্সটাইল মিলসগুলোতে পরিবেশ অধিদপ্তরের অভিযানের খবর পাওয়া যায়নি। ব্যাপক মাত্রায় বায়ুদূষণের অপরাধে পরিবেশ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সম্প্রতি ক্রাউন্ট সিমেন্ট, প্রিমিয়ার সিমেন্ট, শাহ সিমেন্টসহ বিভিন্ন কলকারখানার মালিকদের জরিমানা ও সর্তক করে দেয়া হয়।
নয়াগাঁও এলাকিার বাসিন্দা মনির হোসেন জানান, পশ্চিম ও পূর্ব মুক্তারপুর, নয়াগাঁও, হাটলক্ষ্মীগঞ্জ এলাকার নারী-পুরুষ ও শিশুরা ব্রংকাইটিস, নিওমোনিয়াসহ শ্বাস প্রশ্বাস ও চর্ম রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। এছাড়া গাছপালা ও ফসলাদির ক্ষতি হচ্ছে। ইতিমধ্যে ধলেশ্বরী নদীর তীরে বড় বড় অনেক গাছ মারা গেছে। জেলা প্রশাসন থেকে এই অঞ্চলের নদীর পাড়ে বৃক্ষ রোপন করা হয়েছে বায়ুদূষণের হাত থেকে পরিত্রাণের আশায়। এছাড়া নদীর তীরে গড়া ফ্যাক্টরীগুলো নদী দখল করে নিচ্ছে। শহরের উপকন্ঠ চর মুক্তারপুর এলাকায় ধলেশ্বরী-শীতলক্ষ্যা মোহনা দখল করে জাহাজ নোঙরের জন্য নির্মিত শাহ সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর অবৈধ জেটি স্থাপন করা হয়েছে। গত বছরের ১৬ মে দুপুরে নির্বাহী ম্যাজিষ্ট্রেটের নেতৃত্বে বিআইডব্লিউটিএ শাহ সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর ওই অবৈধ জেটি উচ্ছেদ করতে গিয়ে শাহ সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর কর্তৃপক্ষ ও শ্রমিকদের বাঁধার মুখে ৬ ঘন্টা পর সন্ধ্যায় ফিরে আসে। এর পরদিন উচ্ছেদ অভিযানে নারায়ণগঞ্জ থেকে রুস্তম আনা হয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে সে উচ্ছেদ অভিযান আজো দেখা মেলেনি। ফ্যাক্টরীগুলো নদী দখল করে নেয়ায় ধলেশ্বরী নদী এখন সরু খালে পরিণত হয়েছে। তাই দক্ষিণাঞ্চলের সাথে রাজধানী ঢাকার একামাত্র এই নৌপথটি ঝুকির মধ্যে পড়েছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানী আরিফুল ইসলাম জানান, ধলেশ্বরী, পদ্মা ও মেঘনা নদী বেষ্টিত জনবহুল মুন্সীগঞ্জ কৃষি নির্ভর এলাকা। কিন্তু ধলেশ্বরী, মেঘনা ও ফুলদী নদী তীরের কয়েকটি ফ্যাক্টরীর ইটিপি যথাযথভাবে ব্যবহার না করে বর্জ্য নদীতে ফেলে নদীর পানি ও নির্গত ধোয়ায় মিশ্রিত সিমেন্ট নিশ্বাসের সাথে দেহের অভ্যন্তরে ঢুকায় মুন্সীগঞ্জ জেলা শহর ও আশপাশের মানুষ নানা রোগে ভুগছে। অঞ্চলে যখন নলকুপ ছিল না, তখন নদীর পানিই ছিল মানুষের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন। নদীর পানি দিয়ে রান্না, খাওয়াসহ ব্যাবহার্য সব কাজ চালানো হতো। এলাকার খাল-বিল, নদী নালায় প্রচুর মাছ ছিল। সে সময় জেলেরা মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করতো। বর্জ্যে বিষাক্ত হয়ে সে পানি পান করার অযোগ্য হয়ে পরার উপক্রম হয়ে পরেছে।
বর্তমানে নদীর পানি দুষিত হয়ে পড়ায় বহু প্রজাতির মাছ বিলুপ্তি হয়ে গেছে। জমির ফসল নষ্ট হয়ে পরছে। ধলেশ্বরীর পানির দুর্গন্ধে নদী তীরের মানুষের টিকে থাকা দায় হয়ে পড়েছে। মুক্তারপুরের কৃষক দেলোয়ার হোসেন জানান, সিমেন্ট ফ্যাক্টরীগুলো নদী তীরের অনেক ফসলী জমি কৌশলে দখলে নিয়ে নিয়েছে। যা আছে সেখানে এখন আর ফসল হয় না। তাই কৃষক এখন নিরুপায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে- শাহ সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ২ লাখ ২৫ হাজার বস্তা, প্রিমিয়ার সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ১লাখ ৬০ হাজার বস্তা, ক্রাউন সিমেন্ট ফ্যাক্টরী ১লাখ ৫০ হাজার বস্তা, আল্টাটেক সিমেন্ট আমিরাত সিমেন্ট (আমিরাত সিমেন্ট) ৩০ হাজার বস্তা এবং মেট্রোসেম সিমেন্ট ১৬ হাজার বস্তা দৈনিক উৎপাদন ক্ষমতার অর্থ্যাৎ ৫টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরীর প্রতিদিন ৫ লাখ ৮১ হাজার থেকে ৬ লাখ বস্তা উৎপাদনের ক্ষমতা রয়েছে। তবে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী গড়ে প্রতিদিন এখানে ৩ লাখ বস্তা সিমেন্ট উৎপাদন হচ্ছে। এই সিমেন্ট উৎপাদনে ৬টি সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে কমপক্ষে চার হাজার মানুষ সরাসরি কাজ করছে। যথাযথ প্রতিরোধ ব্যবস্থা না থাকায় ফ্লাই এ্যাশে এই চার হাজার শ্রমিকও ফুস ফুসের নানা রোগে ভুগছেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক সিমেন্ট শ্রমিক জানান, সিমেন্ট ফ্যাক্টরীতে কাজে এসে এখন এ্যাজমা রোগী বনেগেছেন। এমন অনেক শ্রমিকই নানা রোগে ভুগছেন।