আমার নানাবাড়ির পাশেই একটা বড় মসজিদ। একেবারে কোলঘেঁষা বললেও ভুল হবে না। মসজিদে যখন আজান দিত বা রোজার সময় সাইরেন বাজাত, মনে হতো যেন কানের ওপর হচ্ছে। শুক্রবার জুমার নামাজের আগে বয়ান, বিভিন্ন সময় ওয়াজ-মাহফিল লেগেই থাকত। মসজিদের পাশে বাড়ি হওয়ায় খুব স্পষ্টই শোনা যেত। তবে তখন তো এসব বয়ান বা ওয়াজে কী বলা হচ্ছে বা এর মাজেজা কী তা ঠিক বুঝতে পারতাম না। বড় হওয়ার পরও শুনেছি। শুধু ওই মসজিদ কেন আশপাশের মসজিদেও বয়ান হতো। এখন সেসব বিষয় কিছু কিছু বুঝতে পারি। বয়ানে ধর্মই সম্ভবত প্রধান আলোচ্য থাকে। সামাজিক, রাজনৈতিক ইস্যু নিয়ে খুব একটা কথা বলতে শুনিনি।
যাক এবার যে কথা বলতে চাইছি সেটাই বলে ফেলি। গত শুক্রবার জুমার নামাজের আগের বয়ানে নারায়ণগঞ্জের কোনো এক মসজিদের মাওলানা সাহেব সানি লিওনকে নিয়ে কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, সানি লিওনের বাংলাদেশে আসা প্রতিহত করা হবে। দেশের মাটিতে সানির ‘বেলেল্লাপনা’ মেনে নেওয়া হবে না।
খবরটা পড়ার পর মনে হলো একজন মাওলানা সাহেব কেন বয়ানে সানি লিওনকে নিয়ে কথা বলবেন? আর কি কোনো বিষয় ছিল না কথা বলার মতো? দেশে কি কথা বলার ইস্যুর অভাব হয়েছে? মেজাজও একটু খারাপ হয়েছিল।
অনেককে বলতে শুনেছি, হুজুররা কীভাবে সানি লিওনের কথা জানল? তারা কি তাহলে…? আমার প্রশ্ন তাদের কাছে, হুজুররা কেন জানতে পারবে না সানি সম্পর্কে? সংবাদপত্র, অনলাইন বা টেলিভিশন চ্যানেলের এই বিস্ফোরণের যুগে সানি লিওন বা অন্যকিছু জানা কি খুব কঠিন কোনো বিষয়? তবে যাঁরা প্রশ্নটি করেছেন, তাঁদের বলার কারণ অন্য। তারা আসলে বোঝাতে চেয়েছেন, হুজুর-মাওলানা কিংবা হাফেজ তাঁরা কীভাবে একজন ‘পর্নোস্টারকে’ (যদিও সাবেক বলা হয়) চিনবেন বা জানবেন?
কিন্তু কথা হলো, হুজুর-মাওলানারাও তো মানুষ। হয়তো আমার-আপনার মতো তারা সমাজের প্রচলিত বিষয়ে পড়ালেখা করেন না। তাঁদের নামের আগে নানা বিশেষণ রয়েছে। তাঁরাও তো পড়তে-লিখতে বা শুনতে জানেন। আমি-আপনি যদি সানিকে চিনতে বা জানতে পারি, তাহলে তাঁদের চিনতে জানতে দোষ কোথায়? যাক এ নিয়েও বিতর্কে না যাওয়াই শ্রেয়।
ফিরে আসি মাওলানা সাহেবের বয়ান প্রসঙ্গে। সানি সম্পর্কে তাঁর কথা নিয়ে ভেবে দেখলাম উনি সচেতন বা অচেতন যেভাবেই হোক না কেন বিষয়টি নোটিশ করেছেন। উনি হয়তো সামাজিক, সাংস্কৃতিক বা দেশীয় মূলবোধের কথা বিবেচনা করে ওই প্রসঙ্গটি টানেননি। আবার বিবেচনা করে আনতেও পারেন। তিনি হয়তো ধর্মীয় জায়গা থেকেই কথাটা বলেছেন। উনি যে ভাষায় কথা বলেছেন তা আমার পছন্দ হয়নি। অনেকের হয়তো পছন্দ হয়েছে। তবে তাঁর বলার স্বাধীনতা ও অধিকার আছে। সে বিষয়ে আমার মন্তব্য করা ঠিক হবে না। আর সবাই যে আমার পছন্দমতো ভাষায় কথা বলবেন তাও নয়।
এবার আসা যাক সানির ‘বেলেল্লাপনা’ ইস্যুতে। এটা তিনি করবেন কি করবেন না তা আমার জানা নেই। অনুষ্ঠানটি কীভাবে সাজানো হয়েছে তাও আমি জানি না। তবে এর আগে যেসব ভারতীয় তারকারা আমাদের এখানে স্টেজ মাতাতে এসেছেন, তাঁরা বা দর্শক যাঁরা তাদের দেখতে গিয়েছিলেন তাঁরা আসলে কতটা ‘সভ্য’ আচরণ করে তা নিয়ে আমার সংশয় আছে। এসব নামিদামি তারকার কনসার্ট দেখার সুযোগ বা ইচ্ছা কোনোটাই পাইনি কখনো। হয়তো সুযোগ পাইনি বলে ইচ্ছা করেনি। সেগুলোও না হয় বাদ দিলাম, কথা হচ্ছে কেন স্টেজ মাতানোর জন্য আয়োজকরা সানিকে দেশে নিয়ে আসবেন?
এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করার আগে নিশ্চয়ই সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে অনুমতি নিতে হয়েছে। তো এসব জায়গার কাজ করা বোদ্ধা ব্যক্তিরা কেন সানিকে আমাদের দেশে এসে অনুষ্ঠান করার অনুমতি দিলেন? একজন পর্নোস্টারকে দিয়ে কেন অনুষ্ঠান করাতে হবে? আর কোনো তারকা তাঁরা ভারতে খুঁজে পেলেন না? নাকি শুধু মুনাফা করার জন্যই এ উদ্যোগ?
আমি সানির অভিনীত সিনেমা বা গান যতটুকু দেখেছি, তাতে সানির অভিনয়ের চেয়ে তাঁর দেহভঙ্গি ও কথাবার্তাতে শুধু যৌন আবেগেই প্রাধান্য দিতে দেখেছি। তো আমরা কেন এমন যৌনতায় ভরা কাউকে আমাদের এখানে স্টেজ শো করতে নিয়ে আসব। এটা কি আমাদের সমাজ বা সংস্কৃতির সঙ্গে যায় কোনোভাবে? কেন টাকা দিয়ে অন্য দেশের এমন কোনো ‘শিল্পী’কে দেখতে যেতে হবে? এর থেকে তো বরং সিনেমা হলে সানির পনো সিনেমা দেখানোর ব্যবস্থা করাই উত্তম।
আমাদের দেশে একসময় মুনমুন, ময়ূরীর বেশ নামডাক ছিল। সিনেমায় অশ্লীল দৃশ্য বা যৌন আবেদনময়ী দৃশ্যে অভিনয়ের জন্য তাঁদের বেশ খ্যাতি ছিল। সিনেমা থেকে অশ্লীলতা বাদ দেওয়ার জন্য তাঁদের বর্জন করা হয়। তো তাঁদের নিয়ে কি ভারত স্টেজ শো করছে? কিংবা আমাদের দেশেই কি তাঁদের নিয়ে আমরা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছি? তাঁদের গায়ে তো অশ্লীলতার একটা তকমা আমরা এঁটে দিয়েছি। তাঁদের নিয়ে যদি আমার অনুষ্ঠান আয়োজন করতে লজ্জা পাই তবে কেন সেই গোত্রেরই একজন সানি লিওনকে নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে লজ্জা লাগবে না? সানির আন্তর্জাতিক ক্যারেক্টার বলে? মুনমুন-ময়ূরীর আন্তর্জাতিক কোনো পরিচয় নেই বলে?
অশ্লীলতার দায়ে যাত্রাপালায় অভিযান চালান ম্যাজিস্ট্রেট। এ অভিযোগ এনে এমন অনুষ্ঠান বন্ধও করে দেওয়ার খবর আমরা পাই। তো সেখানে কেন সানি লিওনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে তাও বেশ সাড়ম্বরপূর্ণভাবেই?
ভারতীয় চলচ্চিত্র আন্তর্জাতিক মানের বলে আমরা তাদের তৃতীয়, চতুর্থ বা এর থেকে নিচু পর্যায়ের যে কাউকে দেশে নিয়ে এসে অনুষ্ঠান করতে পারি কি? তা সে সানিই হোক বা অন্য যে কেউই হোক। হ্যাঁ আমাদের হয়তো সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন বা ঋতিক ঘটক বা ঋতুপর্ণ ঘোষের মতো পরিচালক নেই। আমাদের এখানে হয়তো ‘পথের পাঁচালী’, ‘মেঘে ঢাকা তারা’ কিংবা ‘তিতলী’র মতো সিনেমা হয় না। আমাদের নেই করন জোহর, ইয়াশ রাজ, রাজ কুমার হিরানি। আমাদের ‘দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে জায়েঙ্গে’, ‘চাক দে ইন্ডিয়া’, ‘বজরঙ্গি ভাইজান’, ‘পিকে’র মতো সিনেমা হয় না। আমাদের হয়তো আমির, শাহরুখ বা সালমানের মতো অভিনেতা নেই। কিন্তু আমাদের এখানেও তো জহির রায়হান, খানা আতা, তারেক মাসুদের মতো পরিচালক ছিলেন বা আছেন। তাঁরাও তো কিছু সৃষ্টি করেছেন। আমাদের এখানেও তো রাজ্জাক, আলমগীর, ইলিয়াস কাঞ্চন, শাবানা, ববিতা, মৌসুমী বা সালমান শাহর মতো অভিনেতারা ছিলেন বা আছেন। তাঁদের নিয়ে কি প্রতিবেশী দেশে এত মাতামাতি হয়েছে? তারা কি আন্তর্জাতিকমানের নয় এটা আমরা বলতে পারব?
যেখানে প্রতিবেশী দেশে আমাদের দেশীয় চ্যানেলগুলো দেখায় না, সেখানে তাদের তারকাদের নিয়ে এতটা মাতামাতি কি একটু বেশি নির্লজ্জতা হয়ে যায় না? তাঁদের খ্যাতি শুধু বিশ্বজোড়া বলেই কি আমরা যা ইচ্ছে তাই করতে পারি?
ভারতীয় সিরিয়াল দেখে নাকি আমাদের দেশে মা-বৌ-মেয়েরা গোল্লায় যাচ্ছে। কারো কারো মতে, রসাতলে বললেও ভুল হবে না। তাদের কুটকাচালি দেখে দেখে নাকি আমাদের নারীসমাজের জাত চলে যাচ্ছে। তারা চুলোয় যাচ্ছে। এসব সিরিয়াল আমাদের এখানে প্রচার বন্ধ করার পক্ষে-বিপক্ষে নানা যুক্তি তুলে ধরা হয়েছে। বিপক্ষেই মতটাই বেশি। বিষয়টি আদালত পর্যন্তও গড়িয়েছে। সুশীলসমাজও এর বিপক্ষে। কিন্তু যখন আমাদের দেশের পরিচালকরা ভারতে গিয়ে ওই ধরনের সিরিয়াল বানানোর প্রশিক্ষণ নেন, তথন কোথায় থাকে আমাদের সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্যবোধ ও মূল্যবোধ?
সিরিয়াল নিয়ে যখন আমাদের এত অ্যালার্জি, তখন সানির মতো যৌনতায় ভরপুর একটা ক্যারেক্টারকে দেশে আনলে দেশের মানুষ কোন জাতে উঠবে? নিঃসন্দেহে সানির অনুষ্ঠানের দর্শক থাকবে তরুণরা। তো তারা সানিকে দেখে কোন জাতে উঠবে? ভারতীয় সিরিয়াল, সংস্কৃতি বা অন্য যা আমাদের সংস্কৃতিতে প্রবেশ করেছে তাকে আগ্রাসী বলে ধুয়া তুলছেন তথাকথিত সচেতন বা সুশীলসমাজ এবং সংস্কৃতি অঙ্গনের লোকজন। তো তাদের কাছে কি একবারও মনে হচ্ছে না, সানিকে আনা আমাদের সংস্কৃতির মূল্যবোধের পরিপন্থী? যাঁরা সাংস্কৃতিক আগ্রসন নিয়ে কথা বলছেন, ডিশ বন্ধ করার দাবি তুলছেন, তাঁরা এখন কোথায়?
বাচ্চারা হিন্দি কথা শিখছে বলে ডোরেমন বন্ধ করে দেওয়া হলো। তো সানির যৌনতায় ভরা নাচ-গান দেখে আমরা কী শিখব? এটা কি আমাদের মূল্যবোধ বা সংস্কৃতিতে আঘাত হানছে না? সেই সব মূল্যবোধওয়ালা মানুষগুলো এখন কোথায়?
তাই বলে বিশ্বায়নের এই যুগে বা উন্মুক্ত আকাশ-সংস্কৃতির সময়ে আমি আপনাদের বলব না আপনার পল্লীগতি, লালনগীতি, রবীন্দ্র বা নজরুল শুনুন শুধু। বলছি না, আপনারা শুধুই চৌরাশিয়ার বাঁশি কিংবা বিসমিল্লা খার সানাই শোনেন। পপুলার কালচার বা জনপ্রিয় সংস্কৃতিকে বাদ দিয়ে চলতে বলব না। চলা যাবেও না। অবশ্যই আপনি সব দেখবেন শুনবেন। কিন্তু নিজের সংস্কৃতিকে বিসর্জন দিয়ে নয়।
আমাকে রক্ষণশীল বলেই মনে হতেই পারে। এ ক্ষেত্রে আমি তথাকথিত মডার্ন বা আধুনিক হতে চাইও না। শুধুই হালকা বিনোদনের জন্য আমি কোনো দেশের তৃতীয় শ্রেণির একজন ‘অভিনয় শিল্পী’কে যাঁকে বলিউডের মূল নায়ক-নায়িকারাই অভিনেত্রী হিসেবে গোনে না। তাঁর সঙ্গে ভালো কোনো শিল্পী অভিনয় পর্যন্ত করতে চায় না। তেমন একজনকে কেন আমি আমার দেশে আনব? এ প্রশ্ন পুরো সাংস্কৃতিক সমাজ, সুশীলসমাজ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে।
অবস্থাদৃষ্টে আমার মনে হচ্ছে, ‘আউল বাউল লালনের দেশে মাইকেল জ্যাকসন আইলোরে, আরে সবার মাথা খাইলো রে। আমার সাধের দোতারা কান্দে রে…’
লেখক : সোহানা তুলি (সাংবাদিক)