সাম্প্রতিক সময়ে শিশু-কিশোর নিধনের ভয়াবহ চিত্র আমাদের ক্রমাগত মর্মাহত করছে। আমরা নিজেদের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারছি না আমরা কি মানুষ! আমরা কাদের হত্যা করছি?
বিভিন্ন সময়ে শিশু নির্যাতন আমাদের দেখতে হচ্ছে। প্রতিরোধের কথা বলতে হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে দেখা যাচ্ছে এই মাত্রা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। শিশুদের নৃশংস নির্যাতন এবং হত্যা করছে আমাদের চারপাশের মানুষেরা। রাজপথে বাক্সবন্দী নির্যাতিত শিশুর লাশ, গ্যারেজের মালিকের হাতে খুন হওয়া শিশুর লাশ, পিটিয়ে মেরে ফেলা কিশোর, মেরে পানিতে ডুবিয়ে রাখা কিশোরী, মায়ের হাতে বিষপানে মৃত্যুবরণকারী শিশু, এমন আরও নানাভাবে হত্যার শিকার শিশুরা আমাদের মানবিক চেতনাকে ধিক্কার দিচ্ছে। আমরা এসব ভয়াবহ নৃশংসতা দেখছি, আমরা মুখ বুজে আছি এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের চোখের সামনে মূল্যবোধের অবক্ষয়ের চিত্রকে স্পষ্ট করে রাখছি।
তাহলে কি বিচারহীনতার সংস্কৃতি আজকের এই মূল্যবোধের বিপর্যয়ের কারণ? কিছু মানুষ ক্রমাগত তলিয়ে যাচ্ছে বিকৃতি আর বর্বরতার নিষ্ঠুর গর্তে। এখান থেকে তাদের টেনে তোলার উপায়হীন এক বাংলাদেশ আমাদের সামনে? সাম্প্রতিক সময় একটি দেশের জন্য দীর্ঘ সময় নয়, কিন্তু বিপর্যয়ের খতিয়ান সময়ের পরিসরকে ক্রমাগত বিস্তৃত করলে তা রুখে দাঁড়ানো কঠিন হয়ে যাবে।
আজ আগস্ট মাসের ৫ তারিখ। ৪০ বছর আগে এই মাসের ১৫ তারিখে আট বছরের শিশু শেখ রাসেলকে হত্যা করেছিল দুর্বৃত্তরা। ওদের কাছে ওর একটাই কথা ছিল, আমি মায়ের কাছে যাব। রাসেলকে মেরে যারা ওকে মায়ের কাছে নিয়ে গিয়েছিল তেমন দুর্বৃত্তদের হাতে শিশুরা নিহত হোক এই বাংলাদেশে, এটা আমাদের কাম্য নয়।
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি একদিন শিশুদের বঙ্গভবনে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। ওরা আপনার আমন্ত্রণে একটি উৎসবমুখর পরিবেশ থেকে খুশি হয়ে ফিরে গিয়েছিল নিজ নিজ ঘরে। সেই ঘর শিশুদের জন্য আজ নিরাপদ নয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, আপনি শিশুদের নিরাপদ ঘর দিন, রাস্তা দিন, জলাশয় দিন। ওদের লাশ যেন কোথাও দেখা না যায়।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শেখ রাসেল আমাদেরও ভাই। দেশবাসী জানে ওর কোনো অপরাধ ছিল না। ও শুধু মায়ের কাছে যেতে চেয়েছিল। ওকে আমরা চোখের জলে স্মরণ করি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি শিশুদের বিচারহীনতার সংস্কৃতি থেকে রক্ষা করুন। আমরা এই নারকীয় হত্যাকাণ্ড দেখতে চাই না।
মানব প্রজাতির বাগানে শিশুরা কুসুমকলি। যারা মনে করে মানব ভবিষ্যতের আগামী দিন বর্তমানের শিশুরা, তাদের উচিত এসব শিশু নামক কুসুমকলিকে ফুটে উঠতে দেওয়া। এই মুহূর্তে বাংলাদেশ এই অসাধারণ শক্তির বাইরে ছিটকে যাক, দেশজুড়ে শিশু নিধনের নানা প্রক্রিয়ায় নিমজ্জিত হোক, আমরা এটা চাই না। আমরা বলতে চাই, ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি’। সুতরাং আজ সময় এসেছে আপামর দেশবাসীর উচ্চস্বরে বলা এবং করা, শিশুদের এই নিধনযজ্ঞ প্রতিরোধে আমি আমার হাতটি বাড়িয়ে দিলাম। আসুন আমরা সবাই মিলে এই প্রতিজ্ঞা করি যেন স্বাভাবিক মৃত্যুর বাইরে আর কোনো শিশুর মৃত্যু না হয়, সম্মিলিতভাবে এই কাজটি করার এখনই সময়।
সেলিনা হোসেন: কথাসাহিত্যিক, চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ শিশু একাডেমী