মুন্সিগঞ্জ, ২০ জানুয়ারি ২০২৪, নাদিম হোসাইন (আমার বিক্রমপুর)
দেশের অন্যতম বৃহৎ আলু উৎপাদনকারী অঞ্চল মুন্সিগঞ্জ। জেলার ৬টি উপজেলার বিস্তীর্ণ জমিতে আলু গাছের সবুজের সমারোহ। বাম্পার ফলনের আশায় আলু গাছের পরিচর্যায় ব্যস্ততা শুরু হয়েছে কৃষক-শ্রমিকের। কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, গেল বছরের তুলনায় এবছর মুন্সিগঞ্জে আলুর আবাদ বেড়েছে। ফলে উৎপাদনও বেশি হবে।
বর্তমানে আলুক্ষেতগুলোতে কোথাও ইঞ্জিন চালিত মেশিনের মাধ্যমে পানি ছিটিয়ে দেওয়া হচ্ছে আবার কোথাও জমিতে থাকা আগাছা পরিস্কার ও কিটনাশক ছিটিয়ে রোগের হাত থেকে গাছ রক্ষায় কাজ করছে কৃষক- শ্রমিকেরা।
এ মৌসুমে জেলায় প্রায় ৩৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। উল্লেখিত জমিতে ১০ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে বলে কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, জেলায় অন্তত ৮০ হাজার কৃষক আলু আবাদের সঙ্গে জড়িত। সকলেই এখন আলু রোপণ করে লাভের আশায় নতুন স্বপ্ন বুনছে। গেল বছরগুলোতে লোকসানের হার কমিয়ে এবছর আরও ভালো ফলনের আশাবাদ তাদের।
সদর উপজেলার চরাঞ্চলের চরকেওয়ার, বাংলাবাজার, মোল্লাকান্দি, শিলই ও আধারা, মহাকালি, বজ্রযোগিনী, রামপাল ইউনিয়ন এবং টংগিবাড়ী উপজেলার আলদি, ধামারণ, কাঠাদিয়া, শিমুলিয়া, যশলং, ধীপুরসহ বিভিন্ন গ্রাম এবং সিরাজদিখান, লৌহজং, গজারিয়া ও শ্রীনগর উপজেলা জুড়েও কৃষকের ব্যস্ততার দৃশ্য লক্ষ্য করা গেছে। তাদের সঙ্গে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে বিভিন্ন জেলার পুরুষ-নারী শ্রমিক ও কৃষকের পরিবারের সদস্যরাও।
একাধিক কৃষকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এবছর সারের দাম ও শ্রমিক খরচ বেশি। বৃষ্টির আগে দেশি ৫০ কেজি আলুর বীজ ছিল ১ হাজার ৮০০ টাকা । বৃষ্টির পরে সেই বীজ ৩ হাজার টাকা থেকে ৩ হাজার ৮০০ টাকা বিক্রি হয়েছে। জমির দামও অনেক বেশি।
সদরের চরাঞ্চলের হোগলাকান্দি এলাকার বাচ্চু মোল্লা বলেন, এবার আমি ৩১০ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করেছি। খরচ হয়েছে ৫ লাখ টাকা। যেটা গতবারের চেয়ে দিগুণ। এবার ঘূর্ণিঝড় মিগজাউমের প্রভাবে বৃষ্টিতে তিন ভাগের দুই ভাগ আলুক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে।
তারপরেও যদি বর্তমান বাজারে যে দাম রয়েছে ওই দাম ঠিক থাকে তাহলে মোটামুটি লোকসান পুষিয়ে নেওয়া যাবে। তিনি বলেন, বাজারে সকল কিছুর দাম বেশি। সারের দাম গত বছরের চেয়ে দিগুণ। আমি আশা করছি, আমার পুরো জমিতে ১ হাজার মন আলু উৎপাদিত হবে। তিনি আরও বলেন, এখনো কোন প্রকার পোকামাকর বা রোগ বালাই আসেনি। তবে আরও কিছুদিন যত্ন নিতে হবে।
একই এলাকার রওশন আলী বেপারী বলেন, গত বছর আলু জমি থেকে বিক্রি করে ভুল হয়েছে। আমার আলু অন্য মানুষ বিক্রি করে লাখ লাখ টাকা লাভ করেছে। জমিতে আলু বিক্রি করেছি ৬০০ থেকে ৮০০ টাকা বস্তা (৫০ কেজি)। তিনি বলেন, গেলো বছরের শেষের দিকে বস্তা বিক্রি হয়েছে ২ হাজার ৮০০ থেকে ৩হাজার টাকা। তবে এবার জমিতে আলু বিক্রি নাও করতে পারি। কিছুদিন আলু বাড়িতে সংরক্ষণ করবো। সরকার যাতে কৃষকের প্রতি নজর দেয়।
সদর উপজেলার মাকহাটি গ্রামের সুমন হালদার বলেন, আলুর ফলন ভাল পেতে হলো রোপণের পর শ্রম দিতে হয়। এবার বৃষ্টিতে কিছুটা লোকসান হয়েছে। আবার এখন কিছু রোগের ধরণ দেখা দিয়েছে। কৃষি অফিসের লোকজন নিয়মিত যোগাযোগ করছে। তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহ ধরে ভাড়া করা মেশিন দিয়ে পানি ছিটিয়ে আলু গাছের পরিচর্যা করছি একটু ভালো ফলনের আশায়।
জানা গেছে, এদের মতো জেলার বিভিন্ন এলাকায় এখন কৃষকরা আলু জমি পরিচর্যা করতে পানি ছিটানো ছাড়াও আগাছা পরিস্কার করতে ব্যস্ত।
একই গ্রামের শ্রমিক মুক্তার হোসেন ও মাসুম জানায়, ভালো ফলনের আশায় কৃষক হারুন মোল্লা গাছ পরিচর্যার জন্য পানি ছিটিয়ে দিতে ৫০০ টাকা মজুরীতে তাদের নিয়োগ করেছেন। তাই সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত রোপণ করা ৬ গন্ডা জমিতে পানি ছিটাচ্ছেন।
মাকহাটি গ্রামের কৃষক নজরুল মোল্লা জানান, তিনি ৪৪ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করেছেন। আলুর ফলন ভালো হবে-এমন আশায় এখন প্রতিদিনই তিনি শ্রমিকদের নিয়ে ইঞ্জিনচালিত মেশিন দিয়ে জমিতে পানি ছিটানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।
নুরাইতলী গ্রামের কৃষক কামাল হোসেন জানান, এবার তিনি ৫৪০ শতাংশ জমিতে আলু রোপণ করছেন। সব খরচ মিলিয়ে প্রতি কানি অর্থাৎ ১৪০ শতাংশ জমিতে আলু আবাদের ব্যয় হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার টাকা।
মুন্সিগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ অফিসার এবিএম ওয়াহিদুর রহমান বলেন, আলু উৎপাদনে বাংলাদেশের মধ্যে শীর্ষ জেলা মুন্সিগঞ্জ। এবছর ৩৪ হাজার ৩৫৫ হেক্টর জমিতে আলু আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিলো। যার শতভাগ পূরণ হয়েছে। গেল বছর মুন্সিগঞ্জ জেলায় আলু উৎপাদন হয়েছে ১০ লাখ ৪৬ হাজার ৪৬৩ মেট্রিক টন। এবছর উৎপাদন আরও বাড়বে। তাই ধারণা করা হচ্ছে এবার ১০ লাখ ৬০ হাজার মেট্রিক টন আলু উৎপাদন হবে মুন্সিগঞ্জে।
তিনি বলেন, জেলার কিছু কিছু জমি থেকে আগাম আলু উত্তোলন শুরু হয়েছে। বাজারে ভালো দামও পাওয়া যাচ্ছে। কিন্ত বর্তমানে যে আলু জমিতে রয়েছে সেগুলো উত্তোলন শুরু হবে মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহ থেকে।
তিনি আরও বলেন, আবহাওয়া ধারাবাহিকভাবে বেশি কুয়াশাচ্ছন্ন থাকলে কিছুটা সমস্যা হতে পারে। আমরা এ বিষয়ে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি যাতে ছত্রাকনাশক ওষুধ দেওয়া হয়। যদি পরিস্থিতি অতিরিক্ত খারাপ হয়ে পরে তাহলে কৃষকরা যাতে কৃষি কর্মকর্তাদের পরামর্শ নেয়।
তিনি বলেন, জেলায় নভেম্বরের শুরুতেই সদর, সিরাজদিখান, লৌহজং, টংগিবাড়ী, গজারিয়া ও শ্রীনগর উপজেলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে আলু আবাদ করা হয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি আলু আবাদ হয়েছে জেলা সদরে। আবাদ করা জমিতে আলু চারা গজিয়ে ওঠায় এখন তা পরিচর্যায় ব্যস্ত সময় পার করছে কৃষককূল।