মুন্সিগঞ্জ, ১১ মে, ২০২২, সাজ্জাদ হোসেন (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ শহরের হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকার ধলেশ্বরী নদীর তীরে সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মাঝে ৩১ মাসের বেশি সময় যাবত শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে আনন্দ পাঠশালা। অথচ এ স্কুলের নেই শ্রেণিকক্ষ, নেই চেয়ার-টেবিল।
বেড়ি বাঁধের পাশে একটি আম গাছের নিচে মাদুর বিছিয়ে শিশুরা পড়াশোনা করে। বর্তমানে ৩০ জন শিক্ষার্থী এখানে নিয়মিত পড়াশোনা করছে। ইতিমধ্যে ২০ জন শিশুকে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি করানো হয়েছে। তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার যোগ্যতা অর্জন করেছে এ স্কুলে পড়াশোনা শেষ করে।
স্কুলটির উদ্যোক্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, হাটলক্ষীগঞ্জ এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষজন বেশি বসবাস করে থাকে। এর ফলে অভিভাবকরা সন্তানদের স্কুলে না পাঠিয়ে আয়ের জন্য কাজ করতে দিয়েছিলেন। একটা সময় রাস্তায় ভিক্ষা করে ঘুরে বেড়াত, বাদাম বিক্রি, কারখানার শ্রমিক, গৃহকর্মী, বোতল সংগ্রহের কাজও করে আসছিল। আনন্দ পাঠশালা তাদেরকে স্কুলে ফিরিয়েছে। ৫-১৪ বছর বয়সী শিশুরা এ স্কুলের শিক্ষার্থী।
জানা যায়, ২০০৯ সালের অক্টোবর মাসে যাত্রা শুরু করে স্কুলটি। সরকারি হরগঙ্গা কলেজের অনার্স পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এ উদ্যোগ নেয়। করোনাকালীন সময়ে শিশুদের মাঝে খাদ্য সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে। এছাড়া প্রতিবারের মতো এবারও প্রায় ৬০ জন শিশুর মাঝে ঈদ সামগ্রী বিতরণ করা হয়েছে।
উদ্যোক্তা শিক্ষকরা জানান, পরিবারের আর্থিক অনটনের কারণে বাবার সাথে রাস্তাঘাটে বাদাম বিক্রি করত ১০ বছরের এক শিশু। তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা বন্ধ করে দিয়ে স্থানীয় সুতার কারখানায় কাজ করছিল আরেক পথ শিশু।বাসাবাড়িতে গৃহকর্মীর কাজও করছিল ৮ বছরের আরেক শিশু। ৪ জন শিশু বোতল সংগ্রহের কাজ করে আসছিল।এসব শিশুদের অভিভাবকদের অনুরোধ করে তাদের সন্তানদের স্কুলমুখী করা হয়েছে। জানাযায়, আনন্দ পাঠশালা নিজ উদ্যোগে শিক্ষা উপকরণ বিতরণ করে থাকে। বিভিন্ন ক্রিড়া প্রতিযোগিতা ও অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়।
সকাল সাড়ে ১০টা থেকে সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত প্রতি রোববার, মঙ্গলবার ও বৃহস্পতিবার এ পাঠদান কার্যক্রম চলে। জাতীয় সংগীত ও শপথ বাক্য পাঠ শেষে শুরু হয় পাঠদান কার্যক্রম। শুরুতে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী নিয়ে স্কুলটি চালু হয়েছিল।
আনন্দ পাঠশালার উদ্যোক্তা ও স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতি আরিফুল ইসলাম জানান, অভিভাবকরা সারাদিন বাসার বাহিরে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত থাকেন। তারাও শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। যার জন্য সন্তানদের সাধারণ শিক্ষাও দিতে পারেননা। আমাদের স্কুলটি তাদের সন্তানদের এ ব্যাপারে ভূমিকা রাখছে।
বাংলা, গণিত, ইংরেজি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিষয়েপড়ানোহয়। হাতে কলমে শিক্ষা দিয়ে প্রাথমিক স্কুলে ভর্তির ব্যবস্থা করানো হয়। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা এসব নিম্ন আয়ের মানুষজন এ জেলা ছেড়ে চলে গেছে। যার কারণে ১০-১২ জন শিশুর স্কুলে আসা বন্ধ। আমাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে কলেজ পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা এগিয়ে এসেছে। সবাই বিনাপারিশ্রমিকে শিশুদেরকে পড়িয়ে থাকেন। বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন স্কুলের বিভিন্ন কর্মকান্ডে সহযোগিতা করে থাকে।
তিনি আরও জানান, স্কুলটি পরিচালনার জন্য একটি কমিটি আছে। তারা সবাই শিক্ষার্থী। তাদের টিউশনের টাকায় একটি তহবিলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন খাতে অর্থ ব্যয় করা হয়। স্কুল কমিটিতে যারা আছেন তারা পাঠদান কার্যক্রমেও অংশগ্রহণ করে থাকেন।
এরা হলো, সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন রনি, সাংগঠনিক সম্পাদক সুমাইয়া রহমান ঐশী, কোষাধ্যক্ষ মেহরাব হোসেন মোল্লা, যোগাযোগ বিষয়ক সম্পাদক নাঈমান শীন প্রমুখ।
এছাড়া সদস্য হিসাবে ২০-২৫ জন আছেন। একেকদিন ৩-৪ জন শিক্ষক ক্লাস নেন। আনন্দ পাঠশালার উদ্যোক্তারা জানান, পাঠদানের জন্য শ্রেণিকক্ষের প্রয়োজন আছে। তাছাড়া আর্থিকভাবে সহযোগিতার দরকার এসব বিষয়ে প্রশাসন এগিয়ে আসলে আমাদের জন্য সহজ হবে পাঠদান কার্ক্রক্রম চালিয়ে যেতে।
১০ বছরের শিক্ষার্থী আমেনা আক্তার জানান, পরিবারের আর্থিক অবস্থা খারাপের জন্য বিভিন্ন বাসায় গৃহকর্মীর কাজ করছিলাম। স্কুলে যাওয়ার সু্যােগ হয়নি। কিন্তু আনন্দ পাঠশালা আমাকে বই হাতে তুলে দিয়েছে। বাবাকে বুঝিয়ে কাজে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি
দুলাল নামে এক শিক্ষার্থী জানান, রাস্তাঘাটে বাদাম বিক্রি করে সংসারের খরচ যোগাতে সহযোগিতা করে আসছিলাম। পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়ার জন্য পরিবারের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলনা। তবে আনন্দ পাঠশালা আমাকে স্কুলমুখী করেছে।এখানে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন ক্লাস করে অনেক কিছু শিখেছি।