মুন্সিগঞ্জ, ২৬ ডিসেম্বর, ২০২২, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
চলতি শীত মৌসুমে দেশের মধ্যাঞ্চলের সবচেয়ে বড় ও প্রাচীন আড়িয়াল বিলে মিষ্টি কুমড়া চাষ শুরু করেছেন কৃষক। বিস্তীর্ণ আড়িয়াল বিলের ২২০ হেক্টর জমিতে এবছর মিষ্টি কুমড়া চাষ হয়েছে। যা থেকে ৪২ মেট্রিক টন কুমড়া উৎপাদিত হবে বলে আশাবাদ স্থানীয় কৃষি অফিসের।
সম্প্রতি আড়িয়াল বিলের মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলার গাদিঘাট এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ বিলজুড়ে রোপণ করা মিষ্টি কুমড়া গাছের একটি বড় অংশ আক্রান্ত হয়েছে অজানা এক রোগে। রোগাক্রান্ত কুমড়া গাছের পাতাগুলোতে সাদা ধবধবে পোকের বাসা। বেশ কয়েকটিতে দেখা গেলো বিবর্ণ রঙ।
ভিডিও প্রতিবেদন:
আড়িয়াল বিলের কৃষক মো. বিল্লাল (৬২) বলেন, আমি ১৬ শতাংশ জমিতে নভেম্বর মাসের শুরুর দিকে মিষ্টি কুমড়ার বিজ বপণ করেছিলাম। এখন গাছগুলো পরিপক্ক হয়েছে। গাছগুলো বড় হওয়ার পরই বেশকিছু গাছে নতুন এক রোগ দেখতে পাচ্ছি। আমার ৫ শতাংশ জমির কুমড়া শ্বেতীরোগে আক্রান্ত হয়েছে। কোন ঔষধে কাজ করে না। যেই গাছে রোগটা হয় সেই গাছে আর ফলন হয় না। সরকারের কাছে আমাদের দাবি তারা একটা ঔষধ বের করুক। তানাহলে পুরো বিলে এই রোগটি ছড়িয়ে পড়বে।
কৃষক আমির হামজা (৪২) বলেন, এই রোগের কোন ঔষধ আমরা পাচ্ছি না। স্থানীয় কৃষি অফিসের সাথেও যোগাযোগ করেছি। তারাও এই রোগের ব্যাপারে বিস্তারিত কিছু বলতে পারেনা। যেগুলো এই রোগে ধরেছে পাশে থাকা বাকি গাছেও এটি ছড়িয়ে পড়ছে। এই রোগে আক্রান্ত মিষ্টি কুমড়া গাছগুলো উপড়ে ফেলতে হচ্ছে। তানাহলে অন্যগাছগুলোও আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এতে বিশাল ক্ষতি হচ্ছে কৃষকের।
কৃষক আনসারউদ্দিন (৪৫) বলেন, দেশে আপনারা যে ৫০ থেকে একশো-দেড়শ কেজি ওজনের মিষ্টি কুমড়াগুলো দেখেন তা এই আড়িয়াল বিল থেকেই যায়। অন্য কোন জায়গায় এই সাইজের মিষ্টি কুমড়া হয় না। এখন যে রোগ বের হইছে কুমড়ার এটার যদি কোন ঔষধ না বের হয় বড় কুমড়া কি, কুমড়া বলতেই চোখে দেখবেন না। যদি সব মিষ্টি কুমড়া এভাবে নষ্ট হয়ে যায়। যদি গাছই নষ্ট হয়ে যায় পরের বছর কুমড়া লাগানোর বীজই পাওয়া যাবে না।
প্রতিবছর শীতের শুরুতে অর্থাৎ অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর মাসে আড়িয়াল বিলের উন্নত পলিমাটির বিস্তীর্ণ উচু ভূমিতে মিষ্টি কুমড়ার বীজ বপণ করে থাকেন কৃষক। ফেব্রুয়ারি-মার্চে যা বিল থেকে তুলে বিক্রি করেন বাজারে। সাম্প্রতিক সময়ে অজানা এক রোগ দেখা দিয়েছে আড়িয়াল বিলে, এই রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে আড়িয়াল বিলের ঐতিহ্যবাহী কুমড়া। রোগটি এভাবে ছড়াতে থাকলে আড়িয়াল বিলের ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টি কুমড়া হুমকির মুখে পড়বে বলে মনে করছেন আড়িয়াল বিলের কৃষকরা।
দেশে কুমড়ার প্রচলিত ১০টি রোগের তথ্য জানা যায়। রোগগুলো হচ্ছে- এস্পারলিজ ফল পচা রোগ, স্ক্যাব রোগ, গামি স্টেম ব্লাইট রোগ, ব্লোজম এন্ড রট রোগ, পাউডারী মিলডিউ রোগ, ডাউনি মিলডিউ রোগ, ঢলেপড়া রোগ, সাদা গুঁড়া রোগ, কুমড়ার মোজাইক রোগ ও পাতা কোঁচকানো রোগ। তবে নতুন যে রোগের ধারণা কৃষকের কাছে এসেছে এই রোগ সম্পর্কে কোন তথ্য আপাতত নেই কৃষি অফিসের কাছে।
শ্রীনগর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শান্তনা রাণী বলেন, শীত মৌসুম শুরু হওয়ার প্রাক্কালে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাং এর প্রভাবে এবছর আড়িয়াল বিলে সবধরনের সবজির আবাদ কম হয়েছে। এরপরও বিস্তীর্ণ আড়িয়াল বিলের ২২০ হেক্টর জমিতে মিষ্টি কুমড়া বীজ বপণ করেছেন কৃষক। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে বা কোন ক্ষয়ক্ষতি না হলে এবছর বিলে ৪২ মেট্রিক টন কুমড়া উৎপাদন হবে। তিনি বলেন, কৃষকরা এবছর নতুন এক রোগের আক্রমণের শিকার হয়েছেন বলে আমরা তথ্য পেয়েছি। এতে মিষ্টি কুমড়ার পাতাগুলোতে ধবধবে সাদা পোকা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা যাচ্ছে, ছত্রাকের আক্রমণে কুমড়া পাতা ও গাছগুলোর এই অবস্থা হতে পারে। কৃষকের প্রতি প্রাথমিকভাবে পরামর্শ হচ্ছে তারা ছত্রাকনাশক কিটনাশক ছিটালে এর থেকে মুক্তি পেতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. খুরশীদ আলম বলেন, আড়িয়াল বিলের একটি ঐতিহ্যবাহী ফসল হচ্ছে মিষ্টি কুমড়া। প্রতিবছরই এখানে প্রচুর মিষ্টি কুমড়া হয়। এর বিশেষ লক্ষণীয় দিক হচ্ছে সাইজ। যেমন গতবছরও আমরা বিল থেকে ৭২ কেজি ও ৯০ কেজি ওজনের মিষ্টি কুমড়া পেয়েছিলাম। একটা মিষ্টি কুমড়ার ওজন ৯০ কেজি এটা কিন্তু বিশাল একটা ব্যাপার। সারাবাংলাদেশের সবাই এটা অবিশ্বাস করে, অবাক হয়। আড়িয়াল বিলেই এটা সম্ভব। কৃষকরা এখান থেকে প্রচুর লাভবান হন। এখানে বিশেষ স্থানীয় একটা জাত চাষ করা হয়। অন্য জায়গায় এই জাতের কুমড়া চাষ করা হলেও এত বড় হয় না।
তিনি বলেন, মিষ্টি কুমড়া চাষ করতে গেলে নতুন করে আমরা কিছু তথ্য পাচ্ছি। কিছু পোকা বা রোগের উপদ্রব হচ্ছে। আমার যেটা ধারণা, এটা ভাইরাসের একটা আক্রমণ হয়েছে। ভাইরাসের আসলে কোন প্রতিকার নেই। ভাইরাস আক্রমণ প্রতিরোধ করতে গেলে গাছটা তুলে ফেলতে হবে। কিন্তু এতে কৃষকরা অনেক ক্ষতিগ্রস্থ হবেন। কিন্তু ভাইরাসের বিকল্প হচ্ছে এটা যাতে ছড়াতে না পারে এজন্য ভাইরাস বহনকারী যে পোকা আছে সেটাকে দমন করতে হবে। যদি পোকাটাকে দমন করা যায় তাহলে ভাইরাস এক গাছ থেকে আরেক গাছে হস্তান্তর হতে পারবে না।
প্রাকৃতিক জলজ ভূমির আধার আড়িয়াল বিলের মাটির কারনে এখানে আলাদাভাবে জৈব সার ব্যবহার করতে হয় না। ফলে এখানের মাটি সুনিষ্কাশিত জৈব পদার্থ সমৃদ্ধ দোঁআশ বা এঁটেল দোঁআশ মাটি হওয়ায় প্রতিবছর ধাণ, কুমড়া, উস্তেসহ নানারকম সবজির উৎপাদন হয়ে থাকে। বছরের ৬ মাস বিলটি থাকে পানির নিচে আর বাকি ৬ মাস থাকে শুস্ক ফসলি জমি।
ঢাকার দোহার, নবাবগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জের শ্রীনগর উপজেলা এবং সিরাজদিখান উপজেলার ১৬ টি ইউনিয়নের ৭০টি গ্রাম নিয়ে আড়িয়াল বিলের অবস্থান। ২৬ মাইল দৈর্ঘ্য এবং ১০ মাইল প্রস্তের এ জলাভূমির আয়তন ১ লাখ ৬৬ হাজার ৬০০ একর। যার বেশিরভাগ অংশই পড়েছে মুন্সিগঞ্জে। বিলটিকে ঘিরে প্রায় ১০ লাখ লোকের জীবন-জীবিকা নির্বাহ হয়ে থাকে।