মুন্সিগঞ্জ, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৩, আমার বিক্রমপুর ডেস্ক (আমার বিক্রমপুর)
আজ ১১ ডিসেম্বর। মুন্সিগঞ্জ হানাদারমুক্ত দিবস। ১৯৭১ সালের এই দিনে মুন্সিগঞ্জ হানাদার মুক্ত হয়। ১৯৭১ সালের ৯ মে হানাদার বাহিনী ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাযজ্ঞ চালায় গজারিয়া উপজেলার ১০ গ্রামে। সেদিন হানাদারেরা ৩৬০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে।
একাত্তরের নয় মাস মুন্সিগঞ্জের বিশাল ক্যানভাস ছিল রক্তমাখা। রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ আর বিভীষিকাময় অবরুদ্ধ জীবনের পর ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর হানাদারমুক্ত হয় মুন্সিগঞ্জ। জেলার বিভিন্ন স্থানে সম্মুখযুদ্ধ আর মুক্তিযোদ্ধাদের একের পর এক সফল অপারেশনের ফলে সরকারি হরগঙ্গা কলেজ ক্যাম্প থেকে ১১ ডিসেম্বর ভোরে হানাদার বাহিনী লেজ গুটিয়ে মুন্সিগঞ্জ শহর ছেড়ে পালায়। গা-ঢাকা দেয় পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর রাজাকাররাও।
৯ মাসের নিস্তব্ধতা ভেঙে মুন্সিগঞ্জের আকাশে উড়ে বিজয় কেতন। মুক্তি বাহিনী ও জনতার আনন্দ মিছিলে মুখরিত হয় মুন্সিগঞ্জের পথ-প্রান্তর।
মুন্সিগঞ্জ জেলায় প্রথম শক্র মুক্ত হয় টংগিবাড়ী উপজেলা। ১৪ নভেম্বর এই উপেজলা মুক্ত হয়। ১৫ নভেম্বর বিবিসিতে এ সংবাদ প্রচারিত হয়।
বিবিসির তথ্য মতে, টংগিবাড়ীই বাংলাদেশে সর্বপ্রথম হানাদার মুক্ত হয়। ১৫ নভেম্বর হানাদার মুক্ত হয় লৌহজং উপজেলা। এই সংবাদও বিবিসি ও আকাশ বাণী থেকে প্রচার করা হয়। ১৭ নভেম্বর শ্রীনগর ও ২০ নভেম্বর সিরাজদিখান শক্র মুক্ত হয়। গজারিয়া মুক্ত হয় ৯ ডিসেম্বর।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বঙ্গবন্ধু সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দিলে ১০ মার্চ মরহুম ডা. এম এ কাদেরকে আহ্বায়ক করে মহকুমা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ২৫ মার্চ রাত ১০টার মধ্যে গজারিয়ার বাউশিয়া ও মেঘনাঘাটের ফেরিগুলো রামচন্দ্রপুরে পাঠিয়ে দিয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের যোগাযোগ বন্ধ করে দেন স্থানীয় এমএনএ অধ্যাপক কে এম শামসুল হুদা।
২৬ মার্চ সকালে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার সংবাদ পান মুন্সিগঞ্জের মুক্তিকামী মানুষ। শহরের প্রাণকেন্দ্র গোয়ালপাড়ায় অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ টেলিফোন এক্সচেঞ্জের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর পাঠানো এই নির্দেশ গ্রহণ করেন তৎকালীন মহকুমা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা মোহাম্মদ হোসেন বাবুল।
সকাল ৯টার দিকে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা প্রয়াত আবুল কাশেম তারা মিয়া শহর জুড়ে মাইকিং করে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার কথা প্রচার করেন। এই সংবাদ শুনতে পেয়ে মুন্সিগঞ্জের আপামর জনতা দিনভর শহরে বিক্ষোভ করতে থাকেন।
অন্যদিকে, বিক্ষুব্ধ জনতা মুন্সিগঞ্জ থানার সামনে বিক্ষোভ মিছিল করেন। স্থানীয় কয়েকজন যুবক মুন্সিগঞ্জ পুলিশ স্টেশনের স্ট্যান্ডে বাঁধা পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে দেন।
সম্ভাব্য শক্রর মোকাবিলার জন্য ওই দিন দুপুরেই মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা এবং মুক্তিকামী ছাত্র-যুবক সম্মিলিত ভাবে অস্ত্রের ট্রেজারি লুট করেন।
ট্রেজারি লুণ্ঠনে মুন্সিগঞ্জের তৎকালীন এসডিও জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীর নেপথ্য সমর্থন ছিল। তাই অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের সময় পুলিশের পক্ষ থেকে কোন ধরনের বাধা আসেনি। সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ট্রেজারির চারটি তালা ভেঙে ১৬০টি রাইফেল আর বিপুল সংখ্যক গোলা বারুদ লুট করে স্থানীয় ছাত্র-যুবকদের মধ্যে বিতরণ করেন।
এটিই ছিল মুন্সিগঞ্জের মুক্তিপাগল যুবকদের প্রথম বিদ্রোহ। যা পাকিস্তানি হানাদারদের টনক নাড়িয়ে দিয়েছিল। সমবেত ছাত্র-জনতা শ্রীনগর, লৌহজং ও টংগিবাড়ী থানার রাইফেল ও গুলি লুট করে।
সিরাজদিখান থানার ওসি মুজিবর রহমান ও গজারিয়া থানার ওসি সৈয়দ আমীর আলী নিজে থেকেই মুক্তিকামী বিদ্রোহী যুবকদের অস্ত্র দিয়ে দেন।
অস্ত্র হাতে পেয়ে যুবকরা মুন্সিগঞ্জ লঞ্চঘাট, সৈয়দপুর লঞ্চঘাট, আবদুল্লাহপুর লঞ্চঘাট, তালতলা লঞ্চঘাট, গজারিয়া লঞ্চঘাট ও লৌহজং নৌবন্দরে প্রতিরোধ গড়ে তোলেন।
২৮ মার্চ বেলা ১১টায় মুন্সিগঞ্জ স্টেডিয়াম টেবিলিয়ামে পাকিস্তানী পতাকা পুড়িয়ে মুক্তি পাগল ছাত্র-জনতার সামনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। একই দিন জনতা বিক্রমপুর অস্ত্রাগার লুট করে এবং বিএনপির বর্তমান ভাইস চেয়ারম্যান ও সাবেক উপ-প্রধানমন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে শ্রীনগর থানার সকল অস্ত্র লুট করে ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক সবাই যুদ্ধে নেমে পড়েন।
দৈনিক দেশ রূপান্তরের আলোকচিত্র সম্পাদক এবং স্টেট ইউনিভারসিটি অব বাংলাদেশের জার্নালিজম কমিউনিকেশন ও মিডিয়া স্টাডিজের খন্ডকালীন শিক্ষক সাহাদাত পারভেজ মুন্সিগঞ্জ জেলার মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কাজ করতে গিয়ে ও এই বিষয়ে গবেষণা করে বলেন, ২৬ মার্চ সকাল থেকেই ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জ থেকে হাজার হাজার মানুষ স্রোতের মতো মুন্সিগঞ্জের দিকে আসতে থাকেন।
মুন্সিগঞ্জের প্রায় প্রতিটা বাড়ি, স্কুল আর নদীর পাড়ের গ্রামগুলো হয়ে ওঠে শরণার্থী শিবির।
মে মাসের শুরুতে সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন ও আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক হামিদুর রহমান সপরিবারে মুন্সিগঞ্জের উত্তর কোটগাঁওয়ে এসে আশ্রয় নেন। এরপর তারা জীবন ঝুঁকির মধ্যে নানা জায়গায় ঘোরপাক খেতে থাকেন। সে সময় মুন্সিগঞ্জের মানুষ তাদের আশ্রয় দিতে পারলেও পাকিস্তানি হানাদার ও দালালদের কারণে নিরাপত্তা দিতে পারেননি।
তিনি বলেন, ৩১ মার্চ নারায়ণগঞ্জ শহরে হানাদারদের আক্রমণের খবর পেয়ে মুন্সিগঞ্জের একঝাঁক বিপ্লবী তরুণ নারায়ণগঞ্জে গিয়ে সম্মিলিতভাবে সেই আক্রমণ প্রতিহতের চেষ্টা করেন।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী যেন মুন্সিগঞ্জে অনুপ্রবেশ করতে না পারে, সে জন্য মুক্তিপাগল বিদ্রোহীপ্রাণ যুবকরা ধলেশ্বরী নদীর পাড়ে অসংখ্য বাংকার তৈরি করে পাহারায় থাকেন। এসব খবরের ভিত্তিতে মে মাসে হানাদার বাহিনী মুন্সিগঞ্জে এসে দানবের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। এরা মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় গণহত্যা চালিয়ে রক্তবন্যা বয়ে দেয়।
একাত্তর সালে মুন্সিগঞ্জ ছিল ঢাকা জেলার একটি মহকুমা। নদীবেষ্টিত গজারিয়া থানা মুন্সিগঞ্জের অন্তর্গত হলেও মূলত এটি ছিল একটি বিচ্ছিন্ন এলাকা।
৮ মে মধ্য রাতে বিশাল প্রস্তুতি নিয়ে একজন পাকিস্তানি মেজরের নেতৃত্বে বেলুচ রেজিমেন্টের দুই শতাধিক সৈন্য গজারিয়ায় ঢুকে পড়ে। পরদিন তারা গজারিয়া উপজেলার ফুলদী নদীর উপকণ্ঠের গোসাইচরসহ গ্রামগুলোতে নারকীয় অভিযান চালিয়ে ৩৫০ জন নিরপরাধ মানুষকে হত্যা করে। এটাই ছিল মুন্সিগঞ্জের সবচেয়ে বড় ও পৈশাচিক গণহত্যা।
ওই দিনই সকাল বেলা হানাদার বাহিনী নৌপথে মুন্সিগঞ্জ শহরে অনুপ্রবেশ করে। ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের মেজর আবদুস সালামের নেতৃত্বে দুই শতাধিক সৈন্যের একটি কোম্পানি মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে ঘাঁটি স্থাপন করে। মুন্সিগঞ্জে ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্ট পাঠানো হয় মূলত গণহত্যা পরিচালনার জন্য।
ট্রেজারি লুটের ঘটনায় ১১ মে হানাদার বাহিনী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান দেহরক্ষী মোহাম্মদ মহিউদ্দিন, মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতা ডা. আবদুল কাদের, মহকুমা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হারুন-অর-রশীদ, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, আনোয়ার হোসেন অনু, ডা. আবদুল মতিন ও ব্যাংকার দেলোয়ার হোসেন পাগলার বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এ দিন তারা পেট্রোল ঢেলে শহরের বেশ কয়েকটি হিন্দুপাড়াও জ্বালিয়ে দেয়।
এদিকে, ১০ মে টংগিবাড়ী উপজেলার আব্দুল্লাহপুর পাল বাড়িতে আক্রমণ চালিয়ে পাক বাহিনী ১৬ জনকে হত্যা করে বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ১২ মে সিরাজদিখান উপজেলার রশুনিয়া রামসিংয়ের বাড়ি এবং মুন্সিগঞ্জ সদর উপজেলার কেওয়ার চৌধুরী বাড়িতে ১৩ মে দিবাগত রাত সাড়ে ৩টায় ঘেরাও করে। চৌধুরী বাড়ি থেকে ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা ও তার দুই ছেলে শিক্ষক সুনিল চন্দ্র সাহা, দ্বিজেন্দ্র লাল সাহা এবং প্রফেসর সুরেস ভট্টাচার্য, শিক্ষক দেব প্রসাদ ভট্টাচার্য, পুলিশের সাব-ইন্সপেক্টর শচীন্দ্র নাথ মুখার্জীসহ ১৭ জন বুদ্ধিজীবীকে ধরে নিয়ে আসে।
১৪ মে সকাল ১০টায় কেওয়ার সাতানিখীল গ্রামের খালের পাড়ে নিয়ে চোঁখ বেঁধে ১৬ জনকে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যা করে ফেলে রেখে যায় পাক বাহিনী।
আর ডা. সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহাকে ধরে নিয়ে যায় হরগঙ্গা কলেজের পাক সেনা ক্যাম্পে। সেখানে নির্যাতনের পর তাকে হত্যা করা হয়। ১২ মে থানায় থানায় ক্যাম্প স্থাপনের মাধ্যমে হানাদাররা পুরো মুন্সিগঞ্জকে মৃত্যু উপত্যকায় পরিণত করে।
আলোকচিত্র সম্পাদক সাহাদাত পারভেজ আরও বলেন, তিন সপ্তাহ ধরে লাগাতার গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী নিধন, নারী-শিশু নির্যাতন, ধর্ষণ, ধরপাকড়, অগ্নিসংযোগ ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে মেজর সালাম ৩০ মে মুন্সিগঞ্জ ত্যাগ করে। ঢাকায় ফিরে যাওয়ার সময় সে তার লঞ্চে এসডিও জিয়াউদ্দিন এম চৌধুরীর বিরুদ্ধে রাইফেল লুট বন্ধ করতে না পারা, অস্ত্রের ট্রেজারি লুণ্ঠনকারী ছাত্রদের সমাবেশে উপস্থিতি এবং এসডিও বাংলোতে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনসহ নানা অভিযোগ তুলে ধরে।
এর প্রতিবাদে এসডিও কিছু বলতে গেলে মেজর সালাম ধমকের সুরে তাকে থামিয়ে দিয়ে বলে, ‘আপনার সৌভাগ্য যে, মে মাস বলে আপনি আমার সঙ্গে কথা বলতে পারছেন। আর এক মাস আগে হলে আপনাকে কোন কথা বলতে দেওয়া হতো না। আপনি শুধু মেশিনগানের শব্দ শুনতেন।
সেই যাত্রায় এসডিও রেহাই পেলেও পরবর্তী দেড় মাস তাকে ঢাকা সেনানিবাসে মেজর সালামের ঊর্ধ্বতন ব্যাটালিয়ন কমান্ডারের কাছে সপ্তাহে দু’দিন হাজিরা দিতে যেতে হতো। এ সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এসডিওর নানা কর্মকাণ্ড নিয়ে তদন্ত করে। তদন্ত শেষে জিয়াউদ্দিন চৌধুরীকে গ্রে (কালো বা সাদা নয়) আখ্যায়িত করে জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে মানিকগঞ্জে বদলি করে। আর মানিকগঞ্জের এসডিও বাহাদুর মুনশি আসেন মুন্সিগঞ্জে।
মেজর সালাম চলে যাওয়ার পর মুন্সিগঞ্জের হানাদার বাহিনীর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পায় মেজর জাবেদ রহিম। এই জাবেদ রহিম ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইটে সরাসরি যুক্ত ছিল।
জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময় মুন্সিগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজে অ্যাসিস্ট্যান্ট সাব-মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়। এর প্রধান হিসেবে যোগ দেয় ক্যাপ্টেন এম ছিদ্দিক (ইপিসিএ)। সে ছিল এক ভয়ংকর বেলুচি সেনা কর্মকর্তা। এই মার্শাল ল’ আদালত পাকিস্তান বিরোধী শত শত যুবকের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। হুলিয়া মাথায় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধের পুরো সময় যুবকরা আত্মগোপনে থেকে শক্র ঘাঁটিতে কখনো প্রকাশ্যে, কখনো চোরাগোপ্তা হামলা চালায়।
মেজর জাবেদ রহিম ও ক্যাপ্টেন সিদ্দিকের প্রত্যক্ষ নির্দেশে মুন্সিগঞ্জের পরবর্তী গণহত্যাগুলো সংঘটিত হয়। একাত্তর সালের ৯ মাসে ৩৬৯ বর্গমাইল আয়তনের মুন্সিগঞ্জে ৪২টি স্থানে ১৪৫টি গণহত্যা সংঘটিত হয়।
এদিকে, জুনের মাঝামাঝিতে মুক্তি বাহিনী অস্ত্রসহ ট্রেনিং নিয়ে ভারত থেকে স্বদেশে আসতে থাকলে যুদ্ধ তীব্রতর হয় এবং পাক বাহিনীর ঘাঁটিগুলোতে সফল আক্রমণ চালাতে থাকে। জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে শহরের পুরানো কাচারিস্থ উকিল লাইব্রেরীর কক্ষে শান্তি কমিটির এক জরুরী সভায় মুক্তিযোদ্ধারা মুসলিম লীগের এক প্রভাবশালী নেতাকে হত্যা করে। এরপর শান্তি কমিটির নেতারা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে আত্মগোপন করে।
১ আগস্ট বিএলএফ’র মুন্সিগঞ্জ জেলা কমান্ডার (৬ থানা) করা হয় বর্তমান সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ইউনিট কমান্ডের সাবেক কমান্ডার মো. আনিসউজ্জামান আনিসকে।
এই ৬টি থানাকে দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। মুন্সিগঞ্জ সদর, গজারিয়া ও টংগিবাড়ী-এই তিন থানার প্রধান করা হয় মোহাম্মদ হোসেন বাবুলকে এবং শ্রীনগর, লৌহজং ও সিরাজদিখান থানার বিএলএফ’র প্রধান করা হয় জাপা নেতা মরহুম অ্যাডভোকেট শহীদুল আলম সাঈদকে।
১৪ আগস্ট রাতে মুক্তি সেনারা সর্বপ্রথম লৌহজং থানায় অপারেশন করে দখল করে নেয়। অস্ত্র, গোলা-বারুদ লুট করে থানা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়।
এ অপারেশনের নেতৃত্বে ছিলেন, আনিসুজ্জামান, মরহুম এডভোকেট শহীদুল আলম সাঈদ, মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান মরহুম খালেকুজ্জামান খোকা, মোহাম্মদ হোসেন বাবুল, সাবেক এমপি ইকবাল হোসেন, মরহুম শেখ হুমায়ুন (গোয়ালপাড়া), মরহুম জুলহাস বেপারী (সুখবাসপুর), শহীদ খান, সেন্টু, ডা. মতি, কোলাপাড়ার মরহুম মালেক ও আশ্রাফ উজ্জামান প্রমূখ।
২৫ আগস্ট বাংলাবাজারের ভূ-কৈলাশ বাজারের মসজিদে ঢুকে পাকবাহিনী ৭ জন মুসল্লিকে হত্যা করে। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে পাক সেনাদের বাড়ৈখালীর শিকরামপুরহাটে প্রচন্ড যুদ্ধে শতাধিক পাক সেনা নিহত হয়। পাকিস্তানি সৈন্য বোঝাই ৩টি গানবোট নওয়াবগঞ্জ থেকে শিকরামপুর পৌঁছাতেই মুক্তিসেনারা আত্রমণ চালায়। আর একটি প্রচন্ড যুদ্ধ হয় গোয়ালীমান্দ্রায়।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহে মুক্তি সেনারা ৫-৬ জন রাজাকারকে গোয়ালী মান্দ্রার হাটে প্রকাশ্যে হত্যা করে। এর প্রতিশোধ নিতে শহর থেকে ৩শ’র মতো পাক সেনাকে গোয়ালীমান্দ্রায় পাঠানো হয়। ৩ দিনব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধে মুক্তি সেনাদের হাতে একজন সুবেদারসহ ৭৫ জন পাক সেনার সলিল সমাধি ঘটে। এ যুদ্ধে সেনাদের ৩টি গানবোট নিমজ্জিত এবং গোলা বারুদ ও অস্ত্র মুক্তি সেনাদের হাতে আসে।
গোয়ালীমান্দ্রার যুদ্ধে পরাজয়ের পর পাক বাহিনী রাতের আধারে সিরাজদিখানের শেখরনগর আক্রমণ করে বাড়িঘর ও বাজার জ্বালিয়ে দেয়। ৪ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা টংগিবাড়ী থানা আক্রমণ করে দখল করে নেয়। নভেম্বর মাসে একটি ইসলামী জলসায় দেশ বিরোধী অশালীন বক্তব্য দেওয়ায় মুক্তিযোদ্ধারা আব্দুল্লাহপুর বাজারে পাকিস্থান জামায়েতে ইসলামের ভাইস চেয়ারম্যান আল-মাদীনাকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। ১৩ নভেম্বর (২৭ রমজান) রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ৭ ভাগে বিভক্ত হয়ে মেশিনগান, মর্টার ও গ্রেনেটের অবিরাম বিস্ফোরণ ঘটিয়ে মুন্সিগঞ্জ থানা ও শহর দখল করে নেয়। মুক্তিসেনাদের এ আক্রমণে সিআই ডাক বাংলাতে মারা যায়।
সর্বশেষ ৪ ডিসেম্বর শহরের পার্শ্ববর্তী রামেরগাঁও-রতনপুর গ্রামে মুক্তিসেনাদের সঙ্গে পাকবাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে ৪-৫ জন পাকসেনা ও ৩ জন রাজাকার নিহত হয়।
১০ ডিসেম্বর রাতে মুন্সিগঞ্জের মুক্তিযোদ্ধাদের একযোগে শহর আক্রমণের খবর হায়েনা বাহিনী জানতে পেরে সমস্ত আস্তানা গুটিয়ে রাতের আধারে পালিয়ে যায়। শত্রু মুক্ত হয় মুন্সিগঞ্জ।
১১ই ডিসেম্বর ভোর থেকে দুপুর ২টার মধ্যে মুক্তিযোদ্ধারা শহরে এসে অবস্থান নেয়। মিছিল আর জয় বাংলা শ্লোগানে মুুখরিত হয়ে ওঠে পুরো মুন্সিগঞ্জ শহর।
অন্যদিকে, মুন্সিগঞ্জের বধ্যভূমিগুলোর স্মৃতি সংরক্ষণ, কিছু প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার নাম তালিকায় না উঠা, রাজাকারদের তালিকা প্রকাশ না করা এবং বিভিন্ন দলীয় সরকারের আমলে অমুক্তিযোদ্ধাদের নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় তালিকাভুক্ত হওয়ায় একাত্তরের রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধারা আজও হতাশ।