মুন্সিগঞ্জ, ৫ মার্চ, ২০২৪, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
মুন্সিগঞ্জ জেলা শহরের সদর হাসপাতাল থেকে উত্তর দিকে হাটলক্ষীগঞ্জ ও দক্ষিণে কাচারি পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকায় বিভিন্ন খাবারের রেষ্টুরেন্ট-হোটেলের সংখ্যা অর্ধ শতাধিক। এর মধ্যে বেশ কয়েকটির অবস্থান বহুতল আবাসিক ভবনে।
এসবে রয়েছে আধুনিক খাবার বার্গার, কাচ্চি বিরিয়ানি, রাইস-কারি, গ্রিল-কাবাবসহ বাঙালির চিরায়ত খাবার ভাত-মাছ, মাংসসহ নানা পদ। এসব রেষ্টুরেন্ট-হোটেলে জেলার অন্যান্য উপজেলা থেকে বিভিন্ন কাজে শহরে আসা মানুষজনসহ স্থানীয় বাসিন্দাদেরও নিয়মিত যাতায়াত রয়েছে।
সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও ধারণা করা যায়, প্রতিটি রেষ্টুরেন্ট-হোটেলে গড়ে প্রতিদিন অন্তত ২০০-৫০০ মানুষের যাতায়াত রয়েছে। কিন্তু এসব রেষ্টুরেন্ট-হোটেলের অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা কতটুকু? বিশেষ করে অর্ডার করার পরে যারা রান্না করে খাবার সরবরাহ করেন তাদের অবস্থা কি?
তথ্য বলছে, শহরের প্রায় শতভাগ রেষ্টুরেন্টে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার হয় সিলিন্ডার গ্যাস। ঢাকার বেইলি রোডে গত বৃহস্পতিবার বহুতল ভবন গ্রিণ কোজি কটেজে অগ্নিকাণ্ডে ৪৬ জন মৃত্যুর পর নতুন করে মানুষের মধ্যে আলোচনা- মুন্সিগঞ্জের রেষ্টুরেন্ট-হোটেলগুলোতে পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা আছে তো?
তবে, এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে ফায়ার সার্ভিসের কাছ থেকে জানা গেছে আশঙ্কাজনক তথ্য। এর সাথে মিল পাওয়া গেছে রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির বক্তব্যেও।
সরেজমিন সোমবার জেলা শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় অবস্থিত ৫টি রেষ্টুরেন্ট ঘুরে দেখা যায়, খাবার টেবিলের পাশেই এসব রেষ্টুরেন্টের রান্নাঘর। গ্যাস সিলিন্ডারের বোতলগুলোও ভেতর দিকে। ভোক্তারা যে টেবিলে বসে খাবার খাচ্ছেন তা থেকে রান্নাঘরের দুরত্ব ৪-৫ হাতের বেশি নয়। বেশিরভাগ রেষ্টুরেন্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় তা নিয়েও রয়েছে অগ্নিঝুঁকি। কিন্তু বেশিরভাগ রেষ্টুরেন্টেই ‘অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র’ নেই। যেকয়টির রয়েছে তাও সিটিং ক্যাপাসিটির তুলনায় পর্যাপ্ত নয়।
শহরের মালপাড়া এলাকার ভোক্তা হৃদিতা হক বলেন, ঘুরেফিরে প্রতি মাসে শহরের রেষ্টুরেন্টগুলোতে পরিবার-বন্ধুদের সাথে যাওয়া হয়। ঢাকায় অগ্নিকাণ্ডের পর এখন ভেতরে ভয় কাজ করছে। রেষ্টুরেন্টগুলো দেখতে খুব সুন্দর। কিন্তু কোথায় কি আছে তা বলা মুশকিল। তাই সব রেষ্টুরেন্টগুলোর উচিৎ পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র রাখা এবং সেগুলো ব্যবহারের বিষয়ে ওয়েটার-বাবুর্চি, ক্যাশিয়ার-ম্যানেজারসহ মালিকপক্ষের প্রশিক্ষণ থাকা।
মুন্সিগঞ্জ ফায়ার সার্ভিসের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. আবু ইউছুফ জানান, জেলা শহরের সব রেষ্টুরেন্ট-হোটেলই আসলে ঝুকিপূর্ণ। বেশিরভাগ হোটেল-রেষ্টুরেন্ট, ডায়াগনস্টিক সেন্টার বিশেষ করে যেগুলোর অবস্থান বহুতল ভবনে সেখানে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা পর্যাপ্ত নয়। আমরা শহরের বহুতল ভবনগুলো পরিদর্শন করেছি। তাদের মৌখিকভাবেও বলেছি- চিঠিও দিয়েছি। এরপরও যথাযথ ‘অগ্নি নির্বাপণ’ ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা হলে সংশ্লিষ্টরা অবশ্যই বিষয়গুলোতে কঠোর হবেন। আমরাও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবো।
শহরের বাইটস ও হন্টেড হাউজের রেষ্টুরেস্টের অংশীদার মারুফ হাসান তাবরিজ জানান, আমাদের রেষ্টুরেন্টের যে সিটিং ক্যাপাসিটি সে অনুযায়ী ফায়ার সার্ভিসের পরামর্শমতে আমরা ভবন কতৃপক্ষের পাশাপাশি নিজস্ব ব্যবস্থায় ‘অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র’ রেখেছি। তবে ফায়ার সার্ভিসের ‘ফায়ার লাইসেন্স’ আমাদের নেই। সেটির জন্য বেশ কিছু ধাপ অনুসরণের কথা বলা হয়েছে। সেসব বিষয়ে খোঁজ নিয়ে শীঘ্রই আবেদন করা হবে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে দুইটি বিষয়ে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিতে বলা হয় একটি হলো- যাতে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে দ্রুত বের হয়ে যাওয়ার নিরাপদ পথ থাকে এবং আরেকটি হলো পর্যাপ্ত ‘অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র’ রাখা। যেহেতু আমরাও শহরের বাসিন্দা তাই শহরের ভোক্তাদের নিরাপত্তা আমাদের চিন্তার বাইরে নয়। আমরা এই ধাপ দুইটি যথাযথ অনুসরণ করেছি।
শহরের সবচেয়ে বড় আয়তনের রেষ্টুরেন্ট সিক্রেট টেস্ট এবং হাজী রেস্তোরাঁর মালিক আসাদুল্লাহ আল গালিব জানান, আমাদের পর্যাপ্ত অগ্নি নির্বাপণ যন্ত্র রাখা আছে এবং সেগুলো ব্যবহারের বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে রান্নাঘরে যারা আগুনের সামনে কাজ করেন তাদের ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।
মুন্সিগঞ্জ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক ও ইউরো ক্যাফে শর্মা হাউজ রেষ্টুরেন্টের মালিক রহমান সাদি ফায়ার সার্ভিসের তথ্যের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, শহরের বেশিরভাগ রেষ্টুরেন্ট হোটেলেই সিলিন্ডার গ্যাস ব্যবহার করা হয়। আবাসিক গ্যাস লাইন রয়েছে মাত্র দুই-একটির। অন্যদিকে বেশিরভাগ রেষ্টুরেন্টের ‘ফায়ার লাইসেন্স’ নেই। তারপরও সবাই নিজেদের মত করে অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা রেখেছে। এ বিষয়ে আমাদের পক্ষ থেকে যতটুকু যা সচেতনতামূলক কার্যক্রম নেয়ার দরকার আমরা নিবো। শীঘ্রই সবাইকে নিয়ে বসারও পরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।
মুন্সিগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) আশরাফুল আলম বলেন, প্রতিটি বহুতল ভবন নির্মাণের সময়ই বেশ কিছু নিয়ম অনুসরণ করতে হয়। এর মধ্যে অন্যতম একটি বিষয় হচ্ছে ভবনটিতে যথাযথ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা থাকতে হবে। এরপরও মুন্সিগঞ্জ শহরে যেসকল বহুতল ভবনে যথাযথ অগ্নি নির্বাপণ ব্যবস্থা নেই সেগুলোর মালিকদের ফায়ার সার্ভিসের পক্ষ থেকে বারবার চিঠি দেয়া হয়েছে। বিশেষ করে হোটেল-রেষ্টুরেন্ট, ডায়াগনস্টিক সেন্টার যে ভবনগুলোতে অবস্থিত অর্থাৎ মানুষের যাতায়াত যেসকল স্থাপনাগুলোতে বেশি সেগুলোর বিষয়ে আমাদের নজরদারি রয়েছে। আমরা নিয়মিত অভিযানও পরিচালনা করছি, সামনেও করবো।