মুন্সিগঞ্জ, ২২ জানুয়ারি, ২০২৩, শিহাব আহমেদ (আমার বিক্রমপুর)
দেখতে নিরেট ভদ্রলোক। গায়ে অভিজাত কোর্ট-টাই, পায়ে দামি জুতা। দেখে বোঝার উপায় নেই এই কথিত ভদ্রলোকের কাছেই প্রতারিত হতে পারেন আপনিও। হারাতে পারেন সর্বস্ব।
নানা কৌশলে অজ্ঞান পার্টি চক্রের সদস্যরা নানা বেশে মুন্সিগঞ্জ শহরের বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ স্থানে অবস্থান নিয়ে বিভিন্ন পেশা ও শ্রেণীর মানুষকে সর্বসান্ত করছেন। অজ্ঞান পার্টির টার্গেট কখনো নগদ টাকা, স্বর্ণালংকার আবার কখনো ব্যাটারিচালিত অটো বা মিশুক।
গত ১৫দিনে মুন্সিগঞ্জে এরকম বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে।
গেল ১৩ জানুয়ারি শুক্রবার সন্ধ্যায় মুন্সিগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণের সামনে কোর্ট-টাই পড়া এক প্রতারকের খপ্পরে পড়েন মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার দেওভোগ এলাকার ইমন। হাতে কাগজ দেখিয়ে ঠিকানা জিজ্ঞেস করতেই অচেতন হয়ে পড়েন ইমন। এরপর আর কিছুই মনে নেই তার। চেতনা ফেরার পর দেখেন পকেটে থাকা অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল আর পকেটে থাকা ২৫০০ টাকা নেই। পরে ইমরানকে মুন্সিগঞ্জ আদালত প্রাঙ্গণের মাঠ থেকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে স্বজনরা। সেখানে ইমরানের সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের।
তিনি বলেন, আমার মত সাধারণ মানুষের দেখে বোঝার উপায় নেই দেখতে ভদ্রলোক সেও এমন প্রতারক হতে পারে। তাই সবাইকে বলবো সচেতন হতে। একই কায়দায় নয়, মুন্সিগঞ্জ শহরজুড়ে অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা সক্রিয় আরও নানা কৌশলে।
ইমরানের ঘটনার একদিন পরই ১৪ জানুয়ারি টংগিবাড়ী থেকে যাত্রীবেশে হানিফের মিশুকে উঠেন অজ্ঞান পার্টির ৩ সদস্য। পথে তার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলে কফি খেতে দেন একজন। দৃবৃত্তদের দেয়া কফি খেয়ে অচেতন হয়ে পড়েন ইমরান। ইমরানের জ্ঞান ফেরার আগেই তার ব্যাটারিচালিত মিশুকটি নিয়ে লাপাত্তা হয়ে যান অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। এরপর গুরুতর অসুস্থ ইমরানকে আনা হয় মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে। ঘটনাটি ঘটে মুন্সিগঞ্জ শহরের ডিসি পার্ক এলাকায়। ভুক্তভোগী টংগিবাড়ী উপজেলার সোনারং ইউনিয়নের নেত্রাপতি এলাকার হানিফ শেখ।
হানিফের বড় বোন সুমি বেগম জানান, উপজেলার বালিগাও থেকে মিশুকে ৩ জন মধ্যবয়সী ছেলে মুক্তারপুর আসার কথা বলে আমার ভাইয়ের মিশুকে উঠেন। এরপর তারা পেট্রোল পাম্প আসার বলে জানান মুন্সিগঞ্জে যাবেন। পরে মুন্সিগঞ্জ ডিসি পার্কের সামনে আসার পর থামেন তারা। মিশুক থেকে নেমে ১৫ মিনিট দেরি করতে বলেন ছদ্মবেশী ঐ প্যাসেঞ্জাররা। তাদের কথা অনুযায়ী অপেক্ষা করতে থাকলে ৩ জনের মধ্যে একজন আবার ফেরৎ আসেন। এরপর রাস্তার এক কফি বিক্রেতার কাছ থেকে কফি কিনে তাকে খেতে দেন ঐ ব্যক্তি। সেই কফি খাওয়ার পর জ্ঞান ফিরে দেখেন মিশুক নিয়ে উধাও চক্রের সদস্যরা। এসময় মিশুকের চাবি তার কাছেই ছিলো। কৌশলে তারা মিশুক চালু করে নিয়ে গেছে।
সুমি বলেন, আমার ভাই ভাড়ায় মিশুক চালাতেন। এখন এই মিশুকের মালিক তার মিশুক বুঝিয়ে দিতে আমাদের চাপ দিচ্ছেন। আমরা কোথা থেকে তার মিশুক ফিরিয়ে দিবো। আমাদের সেই সামর্থ্য নেই।
গেল ১৬ জানুয়ারি সকালে মুন্সিগঞ্জ সদরের পঞ্চসারের নয়াগাও এলাকার ইকবাল হাসান রচি মিশুক নিয়ে বাসা থেকে বের হন। সকাল ১১টার দিকে টংগিবাড়ীর বড়লিয়া থেকে যাত্রীর ছদ্মবেশে অজ্ঞান পার্টির ৩ সদস্য তার মিশুকে উঠেন। এরপর দুপুর ১২টা’র দিকে ২জন নেমে মুন্সিগঞ্জ পৌরসভার ভেতরে চলে যান। বাকি ১ জন তাকে নিয়ে আসেন শহরের পুরাতন কাচারি এলাকায় হাইস্কুল মার্কেটের সামনে। এরপর গাড়ি থামিয়ে ভাড়া দিতে গিয়ে ভাংতি না থাকার অযুহাতে দুই কাপ কফি নিয়ে আসেন অজ্ঞান পার্টির ঐ সদস্য। কথার ছলে সেই কফি খেতে দেন রচিকে। কফি খাওয়ার পরই অচেতন রচি, মিশুক নিয়ে লাপাত্তা সংঘবদ্ধ অজ্ঞান পার্টির সদস্যরা। খবর পেয়ে ছুটে আসেন ইকবাল হাসান রচির আত্মীয়-স্বজনরা। ভর্তি করা হয় মুন্সিগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে।
ভুক্তভোগী ইকবাল হাসান রচি বলেন, এ বিষয়ে মুন্সিগঞ্জ সদর থানায় অভিযোগ করেও ঘটনার ৭দিন পেরিয়ে গেলেও মিশুকের কোন সন্ধান বের করতে পারেনি পুলিশ। আমি মিশুকটি ঋণ করে কিনেছি। প্রতি সপ্তাহে কিস্তি দিতে হয়। আমার দুইটি মেয়ে, একটি ছেলে। দুই মেয়ে পড়ালেখা করে। আমার আয়ের রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। পুলিশের কাছে অনুরোধ, শহরে তো কত সিসিক্যামেরা রয়েছে। তারা যাতে আন্তরিকতা নিয়ে আমার মিশুকটি খুঁজে বের করে দেয়।
জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অর্থ) সুমন দেব বলেন, সম্প্রতি মুন্সিগঞ্জ শহরে বেশ কয়েকটি সংঘবদ্ধ অজ্ঞান পার্টির তৎপরতার খবর আমরা থানায় অভিযোগ ও বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছি। এ নিয়ে পুলিশের পাশাপাশি একাধিক সংস্থা কাজ করছে। অপরাধীরা অবশ্যই ধরা পড়বে।
সুমন দেব ব্যক্তিগতভাবে সাধারণ মানুষকে সচেতনতার আহবান জানিয়ে বলেন, হঠাৎ কেউ আপনার বন্ধু হতে চাইলো, আপনাকে কোন কাজ করে দিতে আগ্রহ দেখালো কিংবা আপনাকে কোথাও নিয়ে গেল এ ধরনের লোকজনের সাথে মেশার বিষয়ে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।